সম্পাদকীয়

কীটনাশক সংকট: খাদ্যনিরাপত্তা নয়, বিষনিরাপত্তার দিকে দেশ?

বাংলাদেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। ২০০০ সালে যেখানে ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার টন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টনে। কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর দোহাই দিয়ে এ মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যে শুধু মাটি ও পানিকে দূষিত করছে তা নয়; মানুষের শরীরেও ছড়িয়ে দিচ্ছে নীরব বিষ। দেশের নিবন্ধিত ৩৭৭ কীটনাশকের মধ্যে অন্তত ২৫টি আন্তর্জাতিক মানদ-ে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে স্বীকৃত-যা পরিস্থিতির গভীরতাই তুলে ধরে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন-নিয়ন্ত্রণহীনতা, অনিবন্ধিত পণ্যের ছড়াছড়ি, কৃষকের সীমিত প্রশিক্ষণ এবং করপোরেট ব্যবসার প্রভাবে কৃষি এখন টেকসই পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। প্রতিবছর ০.৬৮৫ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে; আর যেটুকু জমি আছে, তা অধিক মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারে দ্রুত অনুর্বর হয়ে পড়ছে। জীববৈচিত্র্যহানি, পোকামাকড় নিধন ও খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যাওয়ার ফলে পরিবেশও বিপন্ন। আরও ভয়াবহ হলো স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া ছাড়াও এসব রাসায়নিক মানুষের ¯œায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, স্মৃতিভ্রংশ ও পারকিনসনের সম্ভাবনা বাড়ায়, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ গ্লাইফোসেটসহ লাল শ্রেণির বহু বিপজ্জনক কীটনাশক দেশে ‘সবুজ চিহ্ন’ দিয়ে বিক্রি হওয়া শুধু অনৈতিক নয়, প্রাণঘাতীও বটে। সরকারি সংস্থাগুলোও সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, টেকসই কৃষিতে যাওয়া ছাড়া স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পথ নেই। অথচ বাস্তবে প্রশিক্ষণ, নজরদারি, জনসচেতনতা-কোনো ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত অগ্রগতি নেই। কৃষকদের অভিযোগ, মাঠের পরিস্থিতি এত কঠিন যে অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ পাওয়া সত্ত্বেও নিরাপদ চর্চা মানা সম্ভব হয় না। আবার জৈব বা পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্য দামি হওয়ায় অধিকাংশ কৃষকের নাগালের বাইরে। এ অবস্থায় কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ স্পষ্ট। বিপজ্জনক ও অনিবন্ধিত কীটনাশকের বিক্রি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ও মনিটরিং ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়াও কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ ব্যবহারের সরঞ্জাম প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গবেষণা ও জনসচেতনতায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ও জৈব কৃষি প্রযুক্তি সাশ্রয়ী করার জন্য। কৃষি-বাণিজ্যে বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব ও বাজার নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করতে হবে, যাতে বিপজ্জনক পণ্য বাজারে ঢ়ুকতে না পারে। বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রথম শর্ত-মাটির নিরাপত্তা ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। নিয়ন্ত্রণহীন কীটনাশক ব্যবহার আমাদের শুধু কৃষিকে নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। এখনই শক্ত প্রয়োগ, কঠোর নীতি ও টেকসই কৃষিচর্চায় অঙ্গীকার না করলে আমাদের খাদ্য হবে পুষ্টির নয়, বিষের উৎস।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button