ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ-স্বচ্ছতার উন্মোচনে বাড়ছে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ চিত্র দেশের আর্থিক খাতকে উদ্বেগের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বহু বছর ধরে আড়াল থাকা তথ্য উন্মোচনের ফলে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে এসেছে, তা শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা নয়-নীতিনির্ধারণ, তদারকি ও দায়বদ্ধতার গভীর সংকটও স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ঋণ-শ্রেণীকরণ নীতি এবং বিদেশি অডিট ফার্মের মাধ্যমে যাচাইয়ের কারণে এখন প্রকৃত হিসাব সামনে এসেছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ শেষে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা-যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এক বছর আগেও এই হার ছিল ১৭ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে ভুল হিসাব দেখিয়ে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা আড়াল করা হয়েছে। আরও উদ্বেগজনক হলো-এই বিপুল খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো যে সুরক্ষা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখা উচিত ছিল, তার বড় অংশই নেই। প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪ লাখ ৭৪ হাজার কোটি; বাস্তবে রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তার জন্য এটি ভয়াবহ ঝুঁকি। বিশ^ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যথার্থই বলেছেন-শুধু অর্থনীতির চাপ দিয়ে এই খেলাপি ঋণের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মতো ইতিবাচক সূচক থাকা সত্ত্বেও বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধে অনীহা বরং ইচ্ছাকৃত খেলাপির সম্ভাবনা বাড়ায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কোনো কোনো প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা সুবিধা নেওয়ার জন্য পরিশোধ স্থগিত করেছে-এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেটিও সত্য। করোনা-পরবর্তী ধস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, ডলার সংকট, জ্বালানি অস্থিরতা এবং উচ্চ সুদের হার-এসব কারণে অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তা পরিশোধ সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিক খেলাপির বড় অংশই এসেছে বৃহৎ ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে, যা ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে। এই প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন তিনটি মূল দায়িত্ব-প্রথমত, ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত করে কঠোর আইনি প্রক্রিয়া চালু করা। দ্বিতীয়ত, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের বিশেষ সুবিধা সীমিত করা; বারবার ছাড় দিলে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, প্রভিশন ঘাটতি দ্রুত পূরণে ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোর তদারকি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করার জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এখন অপরিহার্য। খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাব প্রকাশ পাওয়াকে ইতিবাচক বলা যায়; তবে সমাধানমুখী নীতি বাস্তবায়ন না হলে এই উন্মোচন সাময়িক স্বস্তি ছাড়া আর কিছুই দেবে না। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা পুনর্গঠনে এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত প্রয়োজন-নইলে সংকট অর্থনীতির মূলভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিতে পারে।
