সম্পাদকীয়

সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশায় নতুন পথে বাংলাদেশ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট-উভয়ের ভোটগ্রহণ আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের ভাষণের মধ্য দিয়ে তপশিল ঘোষণার পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেছে নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির পর্যায়ে। একই দিনে পৃথক দুই ধরনের ভোট আয়োজন নিঃসন্দেহে একটি নতুন অভিজ্ঞতা এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের বড় পরীক্ষা। সে কারণে ভোট গ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো এবং প্রতিটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কমিশনের প্রস্তুতিকে আরও সুসংগঠিত করার ইঙ্গিত দেয়। সিইসির ১২ মিনিটের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস স্মরণ করে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে অতীতের নানা অভিযোগের পর এমন একটি নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার অবশ্যই ইতিবাচক। নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি, বাদ পড়া প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের নিবন্ধন নিশ্চিত করা, দুই কোটির বেশি তথ্য হালনাগাদ, নারী ভোটার-পুরুষ ভোটারের ব্যবধান কমিয়ে আনা-এসব পদক্ষেপ নির্বাচনের প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করেছে বলেই মনে হয়। পাশাপাশি রেমিট্যান্সযোদ্ধা প্রবাসীদের প্রথমবার পোস্টাল ভোট ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং আইনি হেফাজতে থাকা ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নির্বাচনব্যবস্থার বিস্তৃতি ও অন্তর্ভুক্তিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও উল্লেখযোগ্য। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ একাধিক দলের পক্ষ থেকে তপশিল ঘোষণাকে স্বাগত জানানো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন ধরনের সমঝোতার ইঙ্গিত দেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের গঠন-এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রায় এক বছর পর একটি জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণায় রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা সামনে এগোনোর পথকে আরও মসৃণ করবে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। এক দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের কারণে সময় ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র পরিচালনা ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকির কথাও সিইসি উল্লেখ করেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গুজব ও অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ায় নির্বাচনকে কলুষিত করার ভয় সবসময়ই থাকে। এ কারণে নির্বাচনী সময়ে মিডিয়া, পর্যবেক্ষক সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বিত ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ‘হ্যাঁ-না’ ভিত্তিক চার প্রশ্নে গণভোটের প্রজ্ঞাপন এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন-সবকিছুই দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশনের তিনজন নিজস্ব কর্মকর্তা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেলেন, যা পেশাদারিত্ব ও স্বাধীনতাকে আরও জোরদার করতে পারে বলে আশা করা যায়। এই পুরো প্রক্রিয়া থেকে স্পষ্ট-বাংলাদেশ আজ এমন এক নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, যা কেবল প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের পথই প্রস্তুত করবে না; বরং সাম্প্রতিক অতীতের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের দিকনির্দেশক হিসেবেও কাজ করবে। নির্বাচন কমিশন, অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, সংবাদমাধ্যম এবং সর্বোপরি ভোটার-সবার সম্মিলিত দায়িত্বই এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করে তুলতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করি, ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও গণভোট দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন ভিত্তি স্থাপন করবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button