সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীদের অন্যতম আবাসভূমি। কক্সবাজার ও নাফ নদীর দুই তীরে বিস্তৃত ৩০টিরও বেশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১২ লাখ শরণার্থীর বসবাস; যাদের অধিকাংশই ২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক নিপীড়ন থেকে পালিয়ে এসেছে। এই মানবিক বিপর্যয় এখন কেবল মানবাধিকার সংকট নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা, কূটনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। আট বছর পরও প্রত্যাবাসনের কোনো বাস্তবসম্মত অগ্রগতি না হওয়ায় সংকটটি এখন বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী ও জটিল রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার শিকড় অনেক পুরোনো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে রাখাইন অঞ্চলকে প্রশাসনিকভাবে বাংলার অংশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল; যার ফলে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে জনসংখ্যাগত ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দেখা হয়। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের হাতে নিপীড়ন, হত্যা, নারী ধর্ষণ, গ্রাম পোড়ানোসহ অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে। ২০১৭ সালে রাখাইনের মুসলিম গ্রামগুলোয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযান বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘের তদন্তে এ অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। বাংলাদেশ তখন মানবিকতার খাতিরে সীমান্ত উন্মুক্ত করে লাখো শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দীর্ঘদিন আশ্রয় দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতি স্থানীয় সম্পদের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে, যেমন: বনভূমি ধ্বংস, পানি ও খাদ্য সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাব। স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ ও সামাজিক উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, যা ভবিষ্যতে সংঘাতের আশঙ্কাও সৃষ্টি করতে পারে। নিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো-শরণার্থী শিবিরগুলোয় উগ্রপন্থি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের ঝুঁকি। হতাশা ও অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে এসব সংগঠন শরণার্থীদের মধ্যে উগ্রবাদী চিন্তাভাবনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি মানব পাচার, মাদক ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা- বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। ফলে এ সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের আর অলস কূটনীতি বা শুধু মানবিক সাহায্য-নির্ভর নীতির বিলাসিতার সুযোগ নেই। এখন সময় এসেছে দৃঢ়, বাস্তববাদী ও স্বার্থভিত্তিক কূটনীতি গ্রহণের, যা বিশ্বাসযোগ্য সামরিক শক্তিবৃদ্ধি দ্বারা সমর্থিত হবে। আরাকান আর্মির সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মিত্রতার বহুমুখীকরণ, এবং একটি সংগঠিত রোহিঙ্গা প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button