নির্বাচনী ইশতেহারে ওয়াশ: মৌলিক অধিকারকে কেন্দ্রে আনার সময়

নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি-সমষ্টিগতভাবে ওয়াশ-দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন আলোচনার অংশ হলেও জাতীয় রাজনীতির মূল ¯্রােতে তা কখনোই যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অথচ সুস্থ জীবন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়তে এই খাতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাজধানীতে আয়োজিত সাম্প্রতিক এক নির্বাচনী সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, গবেষক ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা যে অভিন্ন কণ্ঠে ওয়াশকে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তুলেছেন, তা সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে পানিবাহিত রোগ, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এখনো বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। শহর ও গ্রামের মধ্যে পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার বৈষম্য প্রকট; বস্তি, বিহারি ক্যাম্প ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা আরও করুণ। নিরাপদ পানির অভাবে ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানা রোগ নিয়মিত দেখা দেয়, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্য রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিরোধমূলক ওয়াশ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করলে চিকিৎসা ব্যয়ের একটি বড় অংশ সাশ্রয় করা সম্ভব। সংলাপে রাজনৈতিক নেতারা যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো সমস্যার বহুমাত্রিকতা স্পষ্ট করে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অপরিকল্পিত নির্ভরতা, নদী ও জলাধার ধ্বংস, জলপ্রবাহ ব্যাহত হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত-সব মিলিয়ে পানি ব্যবস্থাপনা আজ শুধু অবকাঠামোগত নয়, একটি কৌশলগত ও রাজনৈতিক ইস্যু। অথচ দীর্ঘদিন ধরে পানি ও ওয়াটার পলিটিক্স জাতীয় রাজনীতির প্রান্তেই রয়ে গেছে। ওয়াশ খাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি। নারী, শিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেটের সংকট এখনো প্রকট। মাসিককালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মতো বিষয় সামাজিক অবহেলায় ঢাকা পড়ে আছে। এসব ক্ষেত্রে অবকাঠামোর পাশাপাশি মানসিকতা ও নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া সম্ভব নয়। গবেষণা ও বাস্তবতার মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, সেটিও আলোচনায় উঠে এসেছে। দেশে পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে বহু কার্যকর গবেষণা হলেও সেগুলোর নীতিনির্ধারণে প্রতিফলন সীমিত। এর অর্থ, সমস্যা চিহ্নিত হলেও সমাধান কাঠামোগতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে ওয়াশকে অগ্রাধিকার দেওয়া কেবল প্রতিশ্রুতির বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের প্রশ্ন। মানবাধিকারভিত্তিক, জলবায়ু সহনশীল ও প্রতিবন্ধীবান্ধব নীতির মাধ্যমে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা এবং বৈষম্যহীন বিনিয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন কেবল স্লোগানই থেকে যাবে। নির্বাচনী ইশতেহারে ওয়াশকে কেন্দ্রীয় জায়গা দেওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করা। এখন দেখার বিষয়-এই প্রতিশ্রুতি ভোটের ভাষণেই সীমাবদ্ধ থাকে, নাকি নীতিগত বাস্তবতায় রূপ নেয়।
