কপ৩০-এর ব্যর্থতায় বাড়ল ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অনিশ্চয়তা

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন টানা ১৩ দিনের আলোচনার পরও জীবাশ্ম জ্বালানি বিষয়ে কোনো বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি-জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপে ধাপে বন্ধের রোডম্যাপ, টেকসই অভিযোজন অর্থায়ন, এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো-এসবের বেশির ভাগই রয়ে গেছে ইচ্ছানির্ভর প্রতিশ্রুতির কাগজে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতে থাকা বাংলাদেশসহ বৈশি^ক দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো আরও বেশি হতাশ হয়েছে। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে জলবায়ুর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। উপকূলীয় অঞ্চল, কৃষিজমি, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, খরা ও ঘূর্ণিঝড়-সবখানেই জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ দিন দিন বেড়েছে। বৈশি^ক জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে সীমা না টানলে জলবায়ু উষ্ণতা আরও বাড়বে, যার সরাসরি অভিঘাত পড়বে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা, উপকূলীয় জনপদ ও নদী-নির্ভর জীবিকায়। সেই বাস্তবতায় কপ৩০-এ বাধ্যতামূলক কোনো সিদ্ধান্ত না আসা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। গবেষক পাভেল পার্থের মতে, বেলেম সম্মেলনে ‘গ্লোবাল মুটিরাও’-অর্থাৎ সম্মিলিত উদারতা-শ্লোগানটি গ্রহণ করা হলেও আমাজনের আদিবাসীদের প্রবেশাধিকার না দিয়ে একটি সাংঘর্ষিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈশি^ক জলবায়ু তহবিল বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার না থাকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক গড়িমসির বহিঃপ্রকাশ। তবে ইতিবাচক দিক হলো-বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এনডিসিতে এগ্রোইকোলজি, লোকায়ত জ্ঞান, নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও স্থানীয় অভিযোজনকে যুক্ত করেছে, যা ভবিষ্যৎ জলবায়ু অর্থায়নের দরকষাকষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একশনএইডের আবুল কালাম আজাদ যথার্থই বলেছেন-বাংলাদেশকে নিজের জ্বালানি রূপান্তর নীতিতে আরও দৃঢ় হতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অগ্রসর হওয়ার পথ আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। আঞ্চলিক তিন দেশের জোট-বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান-জলবায়ু কূটনীতিতে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন প্রাপ্তির বাস্তবায়ন-যা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অভিযোজন অর্থায়ন ও ক্ষতিপূরণ তহবিলে ঘোষিত সহায়তা বাস্তবে কবে এবং কীভাবে পাওয়া যাবে-এটাই এখন নজর দেওয়ার বিষয়। বরাবরের মতো প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো পরিবর্তনই আসবে না। বাংলাদেশি যুব প্রতিনিধিদের হতাশার কারণও স্পষ্ট-জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের রোডম্যাপ নেই, ন্যায্য অর্থায়নের নিশ্চয়তা নেই, ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণ আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কপ৩০ আমাদের একটি সীমিত সুযোগ দিয়েছে, পূর্ণ সমাধান নয়। এখন প্রয়োজন শক্তিশালী জলবায়ু কূটনীতি, বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক দাবি, স্বচ্ছ প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি-দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন, ন্যায্য রূপান্তর এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের পথই বেছে নিতে হবে।
