স্থানীয় সংবাদ

নগরীর প্রবেশপথগুলোতে জনভোগান্তি নিয়েই শেষ হচ্ছে বছর

# ১৮ জেলায় চলাচলকারী যাত্রী ও যানবাহনে ভোগান্তি #
# সড়কে ধান রোপন, মাছ অবমুক্তকরণ ও সড়ক অচল করে প্রতিবাদ
# বাইপাস সড়কের একাংশ যেন ধুলির শহর।
# কচ্ছপ গতিতে চলছে গল্লামারী ব্রীজের নির্মাণকাজ
# শিপইয়ার্ড সড়কে যাতায়াত কারিদের দুর্ভোগ নিত্যসঙ্গী

কামাল মোস্তফা: বছর শেষ হতে চললেও খুলনা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বারগুলোর দুর্দশা কাটেনি। জনদুর্ভোগ নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা মোস্তফার মোড় থেকে রায়েরমহল পর্যন্ত সড়ক এবং খানজাহান আলী সেতু থেকে রূপসা ট্রাফিক মোড় পর্যস্ত শিপইয়ার্ড, কেসিসি ও কেডিএ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা সোনাডাঙ্গা বাইপাস সড়ক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বে থাকা গল্লামারী সেতু। সড়কগুলো দিয়ে ১৮ টি জেলার পরিবহন ও যাত্রী যাতায়াত করে। বছরের পর বছর সড়কগুলো বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ভোগান্তি বাড়িয়েছে। পণ্যবাহী পরিবহন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হচ্ছেন শিশু ও নারীসহ সাধারণ এলাকাবাসী।
গল্লামারী ব্রীজ ঃ খুলনা মহানগরীর অন্যতম প্রধান প্রবেশদ্বার গল্লামারী ব্রিজের নির্মাণ কাজের দীর্ঘসূত্রতার ফলে জনভোগান্তির পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে কেই জানেনা। বছর জুড়েই নগরবাসির জনভোগান্তির অন্যতমপ্রধান অনুসঙ্গ ছিল গল্লামারী ব্রীজ।
প্রতিবাদে গত ৩ ডিসেম্বর ব্রিজের নির্মাণ কাজ দ্রুত দৃশ্যমানের দাবিতে এক ঘন্টার জন্য গল্লামারী ব্রিজ অচল কর্মসূচি পালন করে খুলনার বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন।
গল্লামারী ময়ূর নদের উপর পূর্ব থেকেই একটি ব্রিজ থাকলেও জন সংখ্যা ও যানবাহন বৃদ্ধির ফলে সড়ক বিভাগ ২০১৬ সালে সাত কোটি টাকা ব্যয় একটি ব্রিজ নির্মাণ করে। এটি অপরিকল্পিত, ব্রিজ নির্মাণের সময় ময়ূর নদ রক্ষা ও নৌযান চলাচল বিবেচনায় না থাকায় কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ১২ই অক্টোবর নতুন ব্রিজ উদ্বোধন করা হয়। আগের পুরোনো ব্রিজটি ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর ভাঙার কাজ শুরু করে।”
নতুন ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরুর পর ৩ দফায় সময় বর্ধিত করলে ও ব্রিজের নির্মাণ কাজ মাত্র ১৬/১৭ % সম্পন্ন হয়েছে। কতৃপক্ষ দফায় দফায় কাজ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আটকে আছে কাগজে কলমে।
প্রকল্প পরিচালক বিপ্লব কুমার পাল বলেন, “সম্পূর্ণ স্টিল স্ট্রাকচারের তৈরি এ জাতীয় ব্রিজ বাংলাদেশ এই প্রথম। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটা ব্রিজ হবে। শুরুতে ব্রিজের ডিজাইনসহ বেশ কিছু জটিলতা ছিল। পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। সব মিলিয়ে সময় ক্ষেপণ হয়েছে। সবকিছু ওভারকাম করে এখন একটা টাইম সিডিউলের মধ্যে চলে এসেছি। আশা করি খুব দ্রুতই ব্রিজের কাজটা সম্পন্ন হবে।”
রায়েরমহল-মোস্তফার মোড় : ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ‘ঘুর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ পল্লী সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় মোস্তফার মোড় থেকে ৩.২ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজ শুরুর বছর খানেক গড়িমসির পর সময় বাড়িয়ে ঠিকাদার কার্পেটিংয়ের কাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু কাজ শেষ না হতেই অনেক জায়গায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে যায়। ফলে বাড়ছে জনভোগান্তি, ঘটছে দুর্ঘটনা।
সোনাডাঙ্গা বাইপাস ঃ সোনাডাঙ্গা থানার সামনে থেকে জয়বাংলা মোড় পর্যন্ত সড়কটি খুলনা সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তরের অধীনে। এর মধ্যে ময়ূরী সেতুর পূর্বপাশের মালিক কেসিসি। পশ্চিম অংশের দেখভালের দায়িত্ব এলজিইডির। সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশ থেকে ময়ুর ব্রিজ পর্যন্ত ৭৮০ মিটার সড়কটি রাস্তা প্রশস্তকরণে জমি জটিলতায় আটকে আছে।
(কেসিসি) সূত্রে জানা যায়, সোনাডাঙ্গা মডেল থানার পাশ থেকে ময়ুর ব্রিজ পর্যন্ত ৭৮০ মিটার সড়কটি জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারলেনে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত ৬০ ফিট চওড়া রাস্তাটি বর্তমানে কিছু কিছু যায়গায় আছে ৩০-৩৫ ফিট। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কেডিএ দুই দফায় অভিযান চালিয়েছে। জমি বুঝে পেলে কাজ শুরু করবে কেসিসি।
অন্যদিকে ময়ুর ব্রিজের পর থেকে জয় বাংলার মোড় পর্যন্ত এলজিইডি অংশের রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। রাস্তার পাথর উঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধূলি’র কারণে এক প্রকার চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সড়কটিতে পরিবহন চলাচল নেমে এসেছে অর্ধেকে। বরাদ্দ না পাওয়ায় আটকে আছে সংস্কার।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহি প্রকৌশলী(প্রকল্প) মারতোজা আল মামুন বলেন, কেডিএ ও কেসিসি’র সমন্বয়ে অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। টারমিনালের কিছু দোকান আমরা নিজেরা উচ্ছেদ করেছি। সড়কের কাজ শুরুর বিষয়টি কেসিসি’র ওপর নির্ভর করছে।
শিপইয়ার্ড সড়ক ঃ শিপইয়ার্ড সড়ক নগরবাসির গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পরও সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। সড়কের কাজ শেষ না করে ঠিকাদার বিল তুলে লাপাত্তা। সড়কটির এমন বেহাল দশার প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠনগুলো নানান কর্মসূচি পালন করেছে। জমে থাকা পানি কাঁদায় ধান রোপণ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি। যৌথভাবে কাজটি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আতাউর রহমান লিমিটেড ও মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রকল্পের আওতায় সড়ক সংস্কার, লবণচরা সেতু ও মতিয়াখালী সুইসগেট নির্মাণ করা হবে। তবে সাড়ে তিন বছরেরও অধিক সময়ে কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে ৭০ শতাংশ। এরই মধ্যে বিল উত্তোলন করে লাপত্তা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়ক সংস্কারকাজ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখায় ৭ আগস্ট চুক্তিও বাতিল হয়েছে। আবার কবে কাজ শুরু হবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সড়কটির কারণে প্রায় এক যুগ ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন পথচারী ও এলাকাবাসী। এটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মে সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য একনেকে প্রকল্প অনুমোদন করায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) অধীনে চলে যায়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের নয় বছর পর কাজ শুরু করে কেডিএ।
খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ-উজ-জামান বলেন, খুলনা মহানগরীর প্রবেশদ্বারগুলোর এমন দুরাবস্থার মূল কারণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা। শিপইয়ার্ড সড়কটিতে শুরু থেকেই কাজ করা হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। বর্তমানে আগের ঠিকাদার বাদ দিয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। আগের ঠিকাদার কোর্টে মামলা করেছে। এর সমাধান না হলে কাজ আরও পিছিয়ে পড়বে। সবমিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে কাজ করে দ্রুত নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবের দাবি জানাই।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button