ইআইপি নীতিমালাকে জাতীয় শিল্প নীতির সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলগুলো বর্তমানে জাতীয় জিডিপিতে ৩৭ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে। তবে ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (ইআইপি) নীতিমালাকে বাংলাদেশের জাতীয় শিল্প নীতির সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করেছেন তারা। গতকাল সোমবার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনআইডিও) এর যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (ইআইপি) লাইট টাচ কার্যক্রম’ শীর্ষক পাইলট প্রকল্পের সমাপনী কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। কর্মশালায় সুইস স্টেট সেক্রেটারিয়েট ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (এসইসিও) এর অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্প খাতের টেকসই রূপান্তরের একটি কার্যকর রূপরেখা তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিসিক এর চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম এবং বেপজা এর সদস্য (প্রকৌশল) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন। এ বিষয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ‘ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ বা ইআইপি ধারণাটির সূচনা, এর কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং আমাদের দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই উদ্যোগটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কর্তৃপক্ষ, উন্নয়ন সহযোগী এবং শিল্প প্রতিনিধিদের একত্রিত করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে পরিবেশগত মান রক্ষা, সম্পদের দক্ষ ব্যবহার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কগুলোর বিবর্তন বা গুণগত পরিবর্তন হওয়া এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, আমাদের প্রথাগত জমি বরাদ্দ এবং ইউটিলিটি সেবা প্রদানের মডেলগুলো পেছনে ফেলে একটি সমন্বিত, সেবামুখী এবং টেকসই শিল্প ইকোসিস্টেমের দিকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বা ইআইপি ফ্রেমওয়ার্ক আমাদের এই পরিবর্তনের একটি সুশৃঙ্খল পথরেখা প্রদান করে। এক্ষেত্রে আমাদের পরিবেশগত মান, অর্থনৈতিক দক্ষতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং কার্যকর পার্ক ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সচিব বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই ‘জাতীয় শিল্প নীতি ২০২২’ পরিমার্জন এবং একে আরও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এই ইআইপি উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা যার মধ্যে রয়েছে আমাদের সীমাবদ্ধতা বা ঘাটতিসমূহের চিহ্নিতকরণ, বিশ্বমানের সেরা চর্চা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারদের মূল্যবান মতামত এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে সঠিক দিশা দিতে সাহায্য করবে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে, এই লব্ধ জ্ঞান ও শিক্ষাকে কার্যকর নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে রূপান্তর করতে হবে। আর এর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে একটি দৃঢ় ও কার্যকর সমন্বয় থাকা অপরিহার্য। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিসিকের জন্য এই উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ আমরা বর্তমানে ৮৩টি শিল্প এস্টেট পরিচালনা করছি যেখানে মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই খাতের প্রাধান্য রয়েছে। এই কার্যক্রমটি আমাদের পুরনো শিল্প এস্টেটগুলোর আধুনিকায়ন এবং নতুনগুলো তৈরির পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ উভয় দিক নিয়েই গভীরভাবে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ইআইপির এই ‘লাইট-টাচ’ পদ্ধতি আমাদের সামনে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে। এটি দেখিয়েছে যে, শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সবসময় বিশাল অংকের মূলধনী বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। বরং উন্নত তদারকি, শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের মধ্যেও অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। এ প্রকল্পটি শিল্প নীতি, পরিবেশগত আইন এবং এসএমই সহায়তা ব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দিনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কর্তৃপক্ষগুলো কেবল জমি ব্যবস্থাপক হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তারা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়িত্ব, উৎপাদনশীলতা এবং বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে সক্রিয় সেবা প্রদানকারী হিসেবে ভূমিকা রাখবে। বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইআইপি-র মূলনীতিগুলোকে পর্যায়ক্রমে সব শিল্প এস্টেটে বাস্তবায়িত করতে বিসিক শিল্প মন্ত্রণালয়, ইউএনআইডিও এবং আমাদের অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বেপজার সদস্য প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ‘সাস্টেইনেবিলিটি’ বা টেকসই উন্নয়ন একটি কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেপজা শিল্পের এই বিবর্তনকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করে এবং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ফ্রেমওয়ার্কের প্রাসঙ্গিকতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে আমাদের বর্তমান চর্চার তুলনা এবং নীতি-নির্ধারণী সংলাপগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। এ কার্যক্রমগুলো পার্ক-পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শক্তিশালী করা এবং পরিবেশ ও জ্বালানি দক্ষতা উন্নয়নের গুরুত্বকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, বেপজা বর্তমানে একটি শক্তিশালী পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা পরিচালনা করে, যেখানে আমাদের বিশেষায়িত দলগুলো নিয়মিতভাবে অগ্নি নিরাপত্তা, শ্রম পরিস্থিতি, পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স এবং বিভিন্ন অপারেশনাল মানদ- যাচাই করে থাকে। তবে একই সঙ্গে আমরা এটিও স্বীকার করি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটা মনিটরিং, জ্বালানি দক্ষতার ট্র্যাকিং, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পার্ক-পর্যায়ে অংশীদারিত্বমূলক অবকাঠামো সমাধানের ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। বেপজা আমাদের নতুন এবং নির্মাণাধীন জোনগুলোর জন্য একেবারে পরিকল্পনা পর্যায় থেকেই ইআইপি নীতিমালাগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, প্রথাগত প্রশাসনিক ভূমিকা থেকে সরে এসে একটি আধুনিক ও সেবামুখী মডেলে রূপান্তর হওয়ার মাঝেই প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। একটি সবুজ এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিল্পায়নের পথে বাংলাদেশের এই রূপান্তরকে সফল করতে আমরা ইউএনআইডিও এবং সব অংশীজনের সঙ্গে আরও নিবিড় সহযোগিতার প্রত্যাশা করছি। অনুষ্ঠানে দ্য ডেইলি স্টার এর সাংবাদিক ও সহযোগী সম্পাদক মাহিয়া তাবাসসুম সঞ্চালনায় একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পলিসি) সুলতানা ইয়াসমিন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সভাপতি ড. মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন, আইএলও-র সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মইনুল ইসলাম সাইফ এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ-এর হেড অব সাস্টেইনেবিলিটি সুমাইয়া টি, আহমেদ, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার-রিনিউয়্যাবল এনার্জি নুরা আলম। আলোচকরা বলেন, ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মাধ্যমে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিমবায়োসিস’ বা বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের ধারণাটি বাংলাদেশের টেকসই শিল্পায়নের মূল ভিত্তি হয়ে উঠবে। এই রোডম্যাপের সফল বাস্তবায়ন কেবল পরিবেশ রক্ষা করবে না, বরং বাংলাদেশকে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার একটি বৈশ্বিক মডেলে পরিণত করবে যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।



