সম্পাদকীয়

আলুর পাহাড়, কৃষকের দীর্ঘশ^াস: বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট

মাঠে আলু ফলিয়ে কৃষক যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নই আজ তাঁদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ দামে সার-বীজ কিনে ভালো ফলন পেয়েও বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় আলুচাষিরা চরম লোকসানের মুখে। হিমাগারে সংরক্ষিত আলু এখন আর লাভের ভরসা নয়, বরং ‘গলার কাঁটা’। নতুন আলু বাজারে আসতেই পুরোনো আলুর দাম তলানিতে নেমেছে-কোথাও পাঁচ-ছয় টাকা কেজি। এমন দামে বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়াও ওঠে না; উল্টো আলু তুলতে গেলে বস্তাপ্রতি পকেট থেকে আরও টাকা দিতে হচ্ছে। এই সংকট কোনো হঠাৎ দুর্ঘটনা নয়, এটি বহুদিনের কাঠামোগত সমস্যার ফল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। গত মৌসুমে অন্তত ২৫-৩০ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত ছিল, যা প্রায় পুরোটা হিমাগারে গেছে। কিন্তু উৎপাদন পরিকল্পনা, বাজার ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার বহুমুখীকরণে সমন্বয়ের অভাবে সেই উদ্বৃত্তই এখন কৃষক ও হিমাগার-উভয়ের জন্য সংকট হয়ে উঠেছে। সরকার ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার ঘোষণা দিলেও তা এখনো কার্যকর না হওয়ায় বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রজ্ঞাপন ও বাস্তবায়নের এই ফাঁক কৃষকের আস্থা আরও দুর্বল করেছে। একদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় ডিসেম্বর পর্যন্ত আলু সংরক্ষণের অনুরোধ জানায়, অন্যদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষ নোটিশ ও মাইকিং করে আলু তুলে নিতে বলছে-এই দ্বন্দ্ব মাঠপর্যায়ে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। নতুন আলুর সরবরাহ শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। পুরোনো আলুর চাহিদা কমে যাওয়ায় আগাম জাতের চাষিরাও লোকসানে পড়েছেন। উৎপাদন খরচ, পরিবহন ব্যয় ও সংরক্ষণ ভাড়া-সব মিলিয়ে যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে, তা টেকসই নয়। কোথাও কোথাও আলু গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর ঘটনাও ঘটছে, যা কৃষকের অসহায়ত্বের নির্মম প্রতিচ্ছবি। সমস্যার গভীরে রয়েছে আলুর বহুমুখী ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা। দেশে উৎপাদিত আলুর মাত্র ৩-৪ শতাংশ সবজির বাইরে অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়, যেখানে উন্নত দেশগুলোতে বড় অংশ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যায়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস, স্টার্চ, ফ্লেক-এই শিল্পগুলোতে বিনিয়োগ, গবেষণা ও সঠিক জাত ব্যবহারের অভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। ফলে উদ্বৃত্ত হলেই বাজার ভেঙে পড়ে। এই সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি-দুই ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে সরকারি ক্রয় কার্যক্রম দ্রুত কার্যকর করা, হিমাগার ভাড়ায় ছাড় বা প্রণোদনা এবং বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে আলু উৎপাদনের পরিকল্পিত সম্প্রসারণ, বহুমুখী প্রক্রিয়াজাত শিল্পে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রপ্তানি বাজার খোঁজা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। নইলে প্রতিবছরই উদ্বৃত্ত আলু আর কৃষকের দীর্ঘশ^াস-এই চক্র ভাঙা যাবে না।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button