সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: আবেগ নয়, বাস্তবতা-ভিত্তিক সমঝোতার প্রয়োজন

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-দুই দেশের সম্পর্কে রাজনৈতিক ব্যক্তিনির্ভরতা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ-নির্ভর সম্পর্কের ধারা, দীর্ঘমেয়াদে পারস্পরিক আস্থা ও ভারসাম্যের ঘাটতি তৈরি করেছে। একইভাবে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতবিরোধী আবেগকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ব্যবহারও সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দুই দেশের রাজনৈতিক ওঠানামা, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার রদবদল এবং নিরাপত্তা-বাণিজ্যিক স্বার্থ-এসব বিষয় স্বাভাবিকভাবেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রতিফলিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের পারস্পরিক অবিশ^াস, যোগাযোগহীনতা, ভিসা ও যোগাযোগ নীতিতে কঠোরতা, এমনকি গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচারের ঘটনাগুলো দূরত আরও বাড়িয়েছে। এতে কেবল কূটনৈতিক অস্বস্তিই নয়, সীমান্ত পরিস্থিতি, জনমত এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযোগও প্রভাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচনী রাজনীতিতে ভারতবিরোধী বক্তব্যের ব্যবহার বা প্রতিবেশী দেশের ওপর অতিরিক্ত সন্দেহ-কেন্দ্রিক নীতি-দুটিই সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে অন্তরায়। প্রতিবেশী কূটনীতিতে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা সবচেয়ে বড় শক্তি। ক্ষমতার পালাবদলের ওপর সম্পর্ক নির্ভরশীল হলে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়-এই শিক্ষা দুই দেশের জন্যই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের নিরাপত্তা-সংবেদনশীলতা ও আঞ্চলিক উদ্বেগগুলো বিবেচনায় রাখা যেমন জরুরি, তেমনি ভারতেরও প্রয়োজন বাংলাদেশকে একটি বহুমাত্রিক রাষ্ট্রীয় অংশীদার হিসেবে দেখা-কোনো একক রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে নয়। সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত বাণিজ্য, জলবণ্টন, শ্রমবাজার, সীমান্ত-ব্যবস্থাপনা, মানবিক যোগাযোগ ও আঞ্চলিক অবকাঠামোগত সংযোগ-যা দুই দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ উপকার বয়ে আনে। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের জন্য কিছু মৌলিক নীতি জরুরি-স্বচ্ছ কূটনৈতিক যোগাযোগ, ভুল তথ্যের পরিবর্তে প্রমাণভিত্তিক আলোচনার সংস্কৃতি, সীমান্ত ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা মোকাবিলায় যৌথ কার্যক্রম, এবং রাজনৈতিক উত্তাপে প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলা। নির্বাচনের পর সম্পর্ক নতুনভাবে সাজানোর সুযোগটি তাই কেবল কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়-এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। সবচেয়ে বড় বিষয়-বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট দল, ব্যক্তি বা সরকারের সীমায় আবদ্ধ নয়; এটি দুই দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার অংশ। এই বাস্তবতায় আবেগ নয়, পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থ-নির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কই হতে পারে সামনে এগোনোর টেকসই পথ।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button