কৃচ্ছ্রসাধন ও বাজেট সমন্বয়: স্থিতিশীল অর্থনীতির পথে বাস্তববাদী পুনর্বিন্যাস

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন ব্যয় সংকোচনের যে প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন বহন করে। সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়লেও এডিপি বরাদ্দ কমছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ফলে বাজেটের আকার সামান্য কমে প্রায় সাত লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায় নামায়-এটি রাজস্বচাপ, সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি ও ব্যাংক একীভূতকরণের মতো বাধ্যতামূলক দায়ভার বিবেচনায় এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়। এটি স্পষ্ট, বাজেট কাটছাঁটের মূল লক্ষ্য মন্থর অর্থনীতিতে অযৌক্তিক ব্যয় রোধ এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে সম্পদের পুনর্বিন্যাস। তবে একই সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয় সংকোচন দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ আকর্ষণের গতিকে প্রভাবিত করতে পারে-এ আশঙ্কাও অমূলক নয়। বিশেষত, ইতোমধ্যেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৫ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বিনিয়োগ স্থবিরতা ও উৎপাদনশীলতা সংকটের ইঙ্গিত দেয়। প্রথম প্রান্তিকের ব্যয়চিত্রে দেখা যায়-পরিচালন ব্যয় দ্রুত বেড়েছে, অথচ উন্নয়ন ব্যয় তুলনামূলকভাবে স্থবির। দীর্ঘদিনের প্রচলিত প্রবণতার বাইরে এই পরিবর্তন রাজস্বচাপ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাত পুনর্গঠনের চাপের কারণে হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। পরিচালন ব্যয়ের বড় অংশ সুদ পরিশোধ, ভাতা ও মূলধন সহায়তায় ব্যয় হওয়ায় কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসা, মজুরি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যবধান কমা এবং কৃষিক্ষেতে উন্নত ফলনের সম্ভাবনা-এগুলো অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও স্থীতিশীলতার দিকে অগ্রগতির লক্ষণ। তবে এই সূচকগুলোকে স্থায়ী করতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে আস্থার পরিবেশ অপরিহার্য। নীতিগত দিক থেকে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে। পরিচালন ব্যয় কতটা দক্ষতা ও ফলপ্রসূতার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপিত হচ্ছে? এডিপি সংকোচনের ফলে চলমান প্রকল্পগুলোতে অগ্রাধিকার বাছাই কতটা স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক? রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর পাশাপাশি করব্যবস্থায় সংস্কার ও করভিত্তি সম্প্রসারণ কি সমান্তরালভাবে এগোচ্ছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন-উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়ন এবং অপচয় রোধে কঠোর পর্যবেক্ষণ। পাশাপাশি পরিচালন ব্যয়ে দায়শোধ-নির্ভর কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে দক্ষতা ও সেবা-কেন্দ্রিক সংস্কারে অগ্রগতি। এছাড়াও বিনিয়োগবান্ধব নীতি, আর্থিক খাতে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং বেসরকারি খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা। কৃচ্ছ্রসাধন ও বাজেট সমন্বয় স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আবশ্যক-সংযমের সঙ্গে সংস্কার, আর্থিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি উৎপাদন ও বিনিয়োগে নতুন গতি সঞ্চার। এই দুইয়ের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য নির্ণায়ক হয়ে উঠবে।
