ঘন কুয়াশায় মেঘনায় একাধিক লঞ্চের সংঘর্ষ : নিহত ৪

দুই লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল
৪ কর্মীসহ ‘এ্যাডভেঞ্চার-৯’ আটক
হতাহতদের জন্য অনুদানের ঘোষণা
প্রবাহ রিপোর্ট : ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল–ভোলা নৌরুটে ঘন কুয়াশার কারণে মেঘনায় কয়েকটি লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৫ জন। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দিনগত রাত আনুমানিক ২টার দিকে মেঘনা নদীর চাঁদপুরের হাইমচর সীমান্তবর্তী নীলকমল বাংলা বাজার এলাকায় ঢাকাগামী জাকির সম্রাট-৩ লঞ্চের সঙ্গে ঝালকাঠিগামী অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায়ই চারজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন- ভোলার লালমোহন উপজেলার কাজিরাবাদ এলাকার সিরাজুল ইসলাম ব্যাপারীর ছেলে আব্দুল গণি (৩৮), একই গ্রামের মো. কালু খাঁর ছেলে মো. সাজু (৪৫), কচুখালি গজারিয়া গ্রামের মিলনের স্ত্রী রীনা (৩৫) ও চরফ্যাশন উপজেলার আহিমেদপুর গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে মো. হানিফ (৬০)।
চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য বলেন, হাইমচরে মেঘনা নদীতে ঘন কুয়াশার কারণে দুটি লঞ্চের সংঘর্ষ হয়। জানা গেছে, দুর্ঘটনায় লঞ্চেই একজন মারা যান। অন্য আহতদের নিয়ে জাকির সম্রাট লঞ্চটি ঢাকা যাওয়ার পথে বাকি তিনজন মারা যান।
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দুই লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা চারজন। সদরঘাটে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি পরিদর্শনে আসছেন নৌ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, দুর্ঘটনায় চারজন মারা গেছেন।
অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের যাত্রী ইলিয়াস জানান, অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চটি শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঝালকাঠি লঞ্চ ঘাটে নোঙর করে।
এদিকে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী লঞ্চ এম খান-৭ ও চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী ঈগল-৪ লঞ্চের মধ্যেও সংঘর্ষ হয়েছে। আমিরাবাদ এলাকায় এ সংঘর্ষে এম খান-৭ লঞ্চটি মাঝখান থেকে ভেঙে যায়। তবে ঈগল-৪ লঞ্চের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বরিশাল নৌবন্দরে দেখা যায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা এম খান-৭ লঞ্চটি মাঝখান থেকে ভেঙে যাওয়ার পর সেখানে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
লঞ্চটির সুপারভাইজার বলেন, আমাদের এম খান লঞ্চটি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে। চারদিকে প্রচুর ঘন কুয়াশা ছিল। এ সময় চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা ঈগল-৪ লঞ্চ ডান পাশ থেকে এসে ধাক্কা দেয়। এতে লঞ্চে পাশের খুঁটি ভেঙে যায়। তবে যাত্রীদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
মেঘনার দুর্ঘটনায় দুই লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল : মেঘনা নদীতে দুই লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনায় ‘এমভি জাকির সম্রাট-৩’ ও ‘এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯’ লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। তদন্তে এরইমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আরিফ আহমেদ মোস্তফা সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সংঘর্ষের ঘটনায় নৌযান দুটির রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে মেরিন কোর্টে মামলা করা হবে।
সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহাগ রানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমভি জাকির সম্রাট-৩’ ও ‘এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯’ লঞ্চে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহগুলো সদরঘাট টার্মিনালে রাখা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে ভোলার ঘোষেরহাট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা অভিমুখী ‘এমভি জাকির সম্রাট-৩’ লঞ্চটি রাত ২টার দিকে হাইমচর এলাকা অতিক্রম করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ঢাকা-বরিশাল রুটের ‘এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯’ লঞ্চের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনার সময় নদীতে ঘন কুয়াশা থাকায় দৃশ্যমানতা অত্যন্ত কম ছিল।
মেঘনায় লঞ্চ দুর্ঘটনা : ঝালকাঠিতে ৪ কর্মীসহ ‘এ্যাডভেঞ্চার-৯’ আটক : চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে জাকির সম্রাট-৩ ও অ্যাডভেঞ্চার-৯ নামের দুটি লঞ্চের সংঘর্ষে চার জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় এ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চটি ঝালকাঠি টার্মিনাল থেকে আটক করেছে নৌ-পুলিশ। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ঝালকাঠি-২ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ইলেন ভুট্টো ওই লঞ্চে করে তারেক জিয়ার সমাবেশে নেতাকর্মীদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) সকাল ১০টার দিকে এ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চটি ঝালকাঠি টার্মিনালে এলে বরিশাল নৌপুলিশ লঞ্চটি আটক করে।
বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ইলেন ভুট্টো’র ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হক লাবলু জানিয়েছেন, লঞ্চটি ইলেন ভুট্টো’র নেতাকর্মীদের ঢাকায় তারেক জিয়ার জনসভায় নেওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল নৌপুলিশের পুলিশ সুপার নাজমুল হক বলেন, আমি লঞ্চটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার খবর পেয়ে ঝালকাঠিতে এসেছি। এখানে লঞ্চটি আটক করা হয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি, কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
ঝালকাঠি সদর থানার ওসি ইমতিয়াজ মাহমুদ জানান, লঞ্চটি ঝালকাঠিতে নোঙ্গর করার পর লঞ্চের সারেং, সুকানী, সুপারভাইজার ও ইঞ্জিন চালক পালিয়ে গেছেন। পুলিশের হেফাজতে থাকা চারজন কেবিন বয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য অনুদানের ঘোষণা নৌ উপদেষ্টার : নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শুক্রবার রাজধানীর সদরঘাটে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আজকের ঘটনাটি দুঃখজনক।
তিনি বলেন, সব ধরনের পরিবহনের মধ্যে নদীপথ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তারপরও এ ধরনের দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আমি নিজেও নিয়মিত নদীপথে যাতায়াত করি। লক্ষ্য করেছি, অনেক সময় রাতে লঞ্চ চলাচলের সময় লাইট ব্যবহার করা হয় না।
উপদেষ্টা জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই লঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্তদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাতে কুয়াশার মধ্যে কোনো লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না। রাতে কোথাও দাঁড়ালে অবশ্যই লাইট ব্যবহার করতে হবে। এ মৌসুমে বাল্কহেড সকাল ৮টার আগে চলাচল করতে পারবে না। এসব নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করা হবে।
নৌ উপদেষ্টা বলেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঝড় বা তুফানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু যেভাবে দু’টি লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে মনে হয় চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অথবা অন্য কাউকে দিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছিলেন। তবে তদন্ত ছাড়া নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কোনো লঞ্চ চালক সঠিকভাবে লঞ্চ পরিচালনা না করলে, রাতে লাইট ব্যবহার না করলে বা নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের রুট পারমিট ও লাইসেন্স বাতিল করা হবে।



