সম্পাদকীয়

বাল্যবিবাহ বন্ধে একযোগে কাজ করতে হবে

বিবাহ মানবজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং একটি পবিত্র বন্ধন। বিবাহ কেবল নর-নারীর মধ্যে প্রেম, সুখ ও শান্তির মধুর বন্ধনই তৈরি করে না, বরং মানবতার স্থিতিশীলতা ও সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। কিন্তু বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি। সময়ের সাথে সামাজিক কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কোনোভাবেই কমেনি। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মেয়েদের সাধারণত বয়ঃসন্ধির আগে বিয়ে দেওয়া হতো, কিন্তু প্রাক-শিল্প ভারতে, বয়ঃসন্ধিকালে নারীদের বিয়ে করার সম্ভাবনা বেশি ছিল। বাল্যবিবাহ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় মালদ্বীপে বাল্যবিবাহের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম, মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৮ শতাংশ, ভারতে ২৩ শতাংশ, ভুটানে ২৬ শতাংশ, আফগানিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়, এবং ২২ শতাংশের ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়। একটি সুস্থ জাতির জন্য একজন শিক্ষিত মায়ের প্রয়োজন। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ নারী এখনও শিক্ষার সুযোগ পায়না। আর এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও সুনাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রেও একটি বড় বাধা। নারীর ক্ষমতায়নের বড় বাধা হলো এই বাল্যবিবাহ। যে ছেলে বা মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয় তাদের বেশির ভাগেরই উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের সন্তানরাও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সংঘটিত হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, সীমিত আইনি সুরক্ষা, সংঘাত এবং জোরপূর্বক অভিবাসন। বিবাহ মানব জীবনের অতি প্রয়োজনীয় হলেও স্বল্প বয়সে বিয়ে কিংবা বাল্যবিবাহের মাধ্যমে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছর। তবে ২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ বিলের বিধান অনুযায়ী, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশে এবং পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বাল্যবিবাহ হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আইন থাকায় তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না, ফলে দেশে প্রতিদিনই অনেক বাল্যবিবাহ ঘটছে। তাই বাল্যবিবাহ রোধে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের অন্যতম দাবি। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে এখনি নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। প্রথমত শিক্ষা ও চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বাল্যবিবাহের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দিনশেষে সরকারের একার পক্ষে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button