সম্পাদকীয়

স্বাধীনতা দিবস ও বাঙালির সেই গৌরবদীপ্ত দিন

জাফর আল ফারুক
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত / ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে, / নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক / এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা (শামসুর রাহমান)। সত্যিই বাংলায় এসেছে সেই মহার্ঘ্য স্বাধীনতা, বাঙালির সেই গৌরবদীপ্ত দিন। আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশে^র বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে চিরস্মরণীয়, অনন্যসাধারণ একটি দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় দিনটি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা, এই দিনে জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছে বীর শহীদসহ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাদের। মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। ভাষা সংগ্রামেরও মূল সূচনা মার্চ মাসে। পাকিস্তানের দুঃশাসন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামে। দানবরূপী পাকিস্তান রাষ্ট্রের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে বাঙালি ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তোলে। মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়। ’৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-তে শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনসহ দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে এসে উপনীত হয়। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির ধারাবাহিক আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৪৮ থেকে ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পরে ফেব্রুয়ারি হয় আমাদের ভাষা সংগ্রামের মাস। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেই বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বর হত্যাকা-ের শুরু এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটিও দিয়েছেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে। অর্থাৎ সবদিক থেকেই মার্চ মাস বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি অতুলনীয় এবং অবিস্মরণীয় মাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে। একাত্তরের ২৫ মার্চের মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে এক হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল দেশের মানুষ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনারও। এই দিনটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক দুঃখ-কষ্ট-বেদনা, রয়েছে অনেক উচ্ছ্বাস, আবেগ, অনুভূতি আর আনন্দ-বেদনার মিশ্রণ। অনেক রক্ত ও আত্মত্যাগ, অনেক সংগ্রাম, অনেক বেদনার বিনিময়ে এসেছে এ স্বাধীনতা। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সব জানা-অজানা শহীদকে, যাঁরা তাঁদের বর্তমানকে বিসর্জন দিয়ে গেছেন এ দেশের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার জন্য। এ দেশের বীর যোদ্ধা যারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন যে সকল মা-বোন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সেসব বীর সূর্যসৈনিকদের জানাই অজ¯্র সালাম আর শ্রদ্ধা। আমাদের সময় এসেছে ফিরে দেখার, যে মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেদিন আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন পুণ্যভূমি, বীর শহীদেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, এ দেশ কি তা দিতে পেরেছে? কাক্সিক্ষত গন্তব্যে আমরা কি পৌঁছাতে পেরেছি? এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতামতও প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই দেশমাতৃকাকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্যে কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মকে অস্ত্র ধরতে হবে না। তাদের কলম যুদ্ধ করতে হবে, মেধার যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধ হবে দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে। আর সেই যুদ্ধের মাধ্যমে গৌরব ছিনিয়ে আনতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সব মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলার মানুষের জনযুদ্ধ। সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়েই মূলত বাংলার মানুষ বর্বর হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। গণমানুষের জনআকাক্সক্ষার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button