অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: এক নীরব মহামারি

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, যা সাধারণ রোগের চিকিৎসাকেও কঠিন করে তুলছে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবির সাবের আলী এক মর্মান্তিক উদাহরণ, যার শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কার্যকর হয়নি। এটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সারাদেশেই এমন ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এই সংকট আরও গভীর হলে ভবিষ্যতে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে, ‘কার্বাপেনেম রেজিস্ট্যান্স অর্গানিজম’ (সিআরও) শনাক্ত হওয়া রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে, যা চিকিৎসার জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাও অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতাকে মহামারির মতো বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করেছে। ২০২৩ সালের জাতীয় ওষুধ প্রতিরোধী জরিপ অনুযায়ী, কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা ৮২-৮৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঁচ বছরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার বেড়েছে ১১ শতাংশ, যা উদ্বেগজনক। হাসপাতালের আইসিইউ রোগীদের ক্ষেত্রে রিজার্ভ গ্রুপের ওষুধগুলোর প্রতিরোধ হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ৫২ শতাংশ রোগীই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ ধাপের রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিক অহেতুক ব্যবহারের ফলে আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকবে না। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও রোগীদের অসচেতনতার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। গবাদি পশুর খামারে অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগও এই সমস্যাকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশি^ক মহামারি হয়ে উঠছে। উন্নত বিশে^ও এই সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এই সমস্যার ভয়াবহতা আরও প্রকট। অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে নতুন নতুন সুপারবাগ তৈরি হচ্ছে, যা প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রয় ও ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে, চিকিৎসকদের যথাযথ নির্দেশনা অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করেন এবং নির্ধারিত ডোজ শেষ না করে ওষুধ বন্ধ না করেন। শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। গবেষক ও চিকিৎসকদের একসঙ্গে কাজ করে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, খুব শিগগিরই আমরা এমন এক বাস্তবতায় পৌঁছাব, যেখানে সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। অ্যান্টিবায়োটিকের এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, চিকিৎসক, গবেষক, ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।