সম্পাদকীয়

৬৫৪ কোটি টাকার ডেমু ট্রেন: পরিকল্পনার অভাব ও অপচয়ের পরিণতি

বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যখন ২০১৩ সালে চীনের হেবেই প্রদেশের সিএনআর থাঙ্কসান কোম্পানি থেকে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন ক্রয় করেছিল, তখন তা দেশের রেলপথে একটি নতুন যুগের সূচনা বলে মনে হয়েছিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-বিশ^বিদ্যালয় রুটে চলাচলের জন্য এসব ট্রেন আনা হয়েছিল, যার মাধ্যমে যাত্রীদের জন্য উন্নত, দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করার আশা ছিল। কিন্তু সাত বছর পার না হতেই এ ট্রেনগুলো অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে। বর্তমানে ২০টি ডেমু ট্রেনের মধ্যে ১৮টি অচল, এবং যেগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়, তাও কোনো কাজে আসছে না। এটি শুধু একটি অপচয় নয়, বরং একটি বড় ধরনের প্রশাসনিক অবহেলা, পরিকল্পনা ও সমীক্ষার অভাবের ফলস্বরূপ। অভিযোগ উঠেছে যে, এত বড় একটি প্রকল্প গ্রহণের আগে কোনো কার্যকরী সমীক্ষা বা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। দেশের বিদ্যমান রেলপথ, আবহাওয়া, প্রশিক্ষিত জনবল এবং মেরামতের সক্ষমতা – এসব বিষয় কোনোদিন সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। প্রকল্পটি গ্রহণের পর থেকেই নানা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রেনগুলো কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। এর ফলস্বরূপ, খরচের তুলনায় আয়ের পরিমাণ ছিল খুবই কম, এবং মেরামতের খরচ বেড়েই চলেছিল। ২০১৯ সাল থেকে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, আর এসব ট্রেন পড়ে থাকে চট্টগ্রাম ও ঢাকার রেলওয়ে স্থাপনায়। এটি কেবল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভুল পরিকল্পনার দিকেই ইঙ্গিত দেয় না, বরং জনগণের অর্থের অপচয়ের বিষয়টিকেও সামনে নিয়ে আসে। ৬৫৪ কোটি টাকা কোনো ছোট অঙ্ক নয়, আর এই অর্থের অপব্যবহার এবং সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করার ফলে ট্রেনগুলোর মেরামতের জন্য ৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থের বিনিময়ে জনগণ কোনো উপকার ভোগ করতে পারেনি। কেন দেশের প্রয়োজনীয় রেলপথে এসব ট্রেন চলতে সক্ষম নয়, এবং কেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কিংবা প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত রাখা হয়নি? এখানে আরও একটি গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান, এবং তা হলো দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। মেরামত, যন্ত্রাংশ ক্রয় এবং জ্বালানি তেলের ব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অদৃশ্য হয়ে গেছে। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ট্রেনগুলো আর সচল করা সম্ভব নয় এবং সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়তো মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে। কিন্তু যে অবস্থায় ডেমু ট্রেনগুলো পড়ে আছে, তাতে একথা স্পষ্ট যে, এটি শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং একটি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি, যা পুরো জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন। বড় প্রকল্প গ্রহণের আগে তার সঠিক পরিকল্পনা, সমীক্ষা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জনগণের অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। অন্যথায়, রেলওয়ে এবং অন্যান্য খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম কেবলই অপচয়ের আর একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button