সম্পাদকীয়

ফারাক্কা-গজলডোবা বাঁধের ছায়ায় উত্তরাঞ্চলের নদীর মৃত্যু এবং মরুকরণের আশঙ্কা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল একসময় নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ছিল। পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট কিংবা ব্রহ্মপুত্রÑসবই ছিল প্রাণবন্ত, প্রবহমান। কিন্তু গত পাঁচ দশকে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ নির্মাণের পর থেকে এই নদ-নদীগুলো যেন মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছে। গবেষকদের মতে, এসব বাঁধের প্রভাবে ইতোমধ্যে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২০০টি নদীর প্রবাহ থেমে গেছে। নদীমাতৃক সভ্যতা আজ পরিণত হয়েছে শুষ্ক ভূখ-েÑযেখানে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে, আবহাওয়া শুষ্ক, মাটি রিক্ত। তিস্তায় গজলডোবা এবং পদ্মায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্ট জলবণ্টনের বৈষম্য সরাসরি নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। তিস্তা অববাহিকার ৫০টির বেশি নদী এখন মৃতপ্রায়। দিনাজপুর-পঞ্চগড় অঞ্চলেও একই চিত্র। খেয়াঘাট আর নৌকার বদলে সেখানে এখন বিস্তীর্ণ চর আর হাঁটুপানির নদী। শাখা নদীগুলোÑযেমন ধরলা, ঘাঘট, বড়াই, নীলকুমার, চিকলী কিংবা জিঞ্জিরামÑএকসময় যেখানে জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, সেখানে এখন কোনো অস্তিত্বই নেই। এই নদীগুলোর হারিয়ে যাওয়া কেবল ভূ-প্রকৃতিগত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত উজানের পানি নিয়ন্ত্রণের ফল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরের নদীগুলোর পানির স্বত্ব ন্যূনতম আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রক্ষা করা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এর পরিণতিতে এ অঞ্চলে মরুকরণের আশঙ্কা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানবজীবনের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক ড. তুহিদ ওয়াদুদ যথার্থই বলেছেনÑতিস্তা এখন কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মার পানি না থাকায় তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে মেঘনা পর্যন্ত। নদী হারালে হারায় একেকটি অঞ্চলের প্রাণ, তার সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা। এ হুমকি শুধু পরিবেশগত নয়, জাতীয় স্বার্থেও মারাত্মক। সরকারের উচিত, অবিলম্বে আন্তঃদেশীয় আলোচনার মাধ্যমে নদী অধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি সুসমন্বিত নদী পুনরুদ্ধার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবেÑএ শুধু স্লোগান নয়, বাস্তবতার শিকড়ে প্রোথিত এক চরম সত্য। আজ সময় এসেছে, নদীর কথা বলার, নদীর জন্য দাঁড়ানোর।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button