সম্পাদকীয়

মিথ্যা মামলার ফাঁদে নিরীহ মানুষ: আইনের অপপ্রয়োগে গণ হয়রানির আশঙ্কা

সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু আলোচিত মামলার তদন্তে দেখা যাচ্ছে, নিরপরাধ ও অচেনা ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করার প্রবণতা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসের সহিংস ঘটনা ও সামাজিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া শত শত গণ মামলায় এমন অনিয়মের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। এসব মামলায় বাদীরা নিজেরাই স্বীকার করছেন, অভিযুক্তদের অধিকাংশকেই তারা চেনেন না, এমনকি কখনো দেখেনওনি। এই প্রবণতা আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে এবং বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলছে। একজন নিরীহ নাগরিক যখন বিনা কারণে মামলায় অভিযুক্ত হন, তখন সেটি শুধু ব্যক্তি হয়রানির ঘটনা নয়-তা হয়ে ওঠে সমাজের সার্বিক নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক। চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমের বক্তব্যে। তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, “মামলা সত্য হলেও আসামির সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, একেকটি মামলায় পাঁচ-দশ জন প্রকৃত অপরাধীর বিপরীতে ৩০০ জনের নাম এজাহারে ঢ়ুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার অনেকেই নিরীহ, অপ্রাসঙ্গিক, কিংবা হয়রানির শিকার। এই ‘মামলা বাণিজ্য’-কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজ চক্র। অভিযোগ রয়েছে, বাদীর সম্মতিতে কিংবা রাজনৈতিক ‘নেতার’ নির্দেশে মামলা থেকে নাম কাটাতে কোটি কোটি টাকা দাবি করা হচ্ছে। এই বাস্তবতা কেবল আইন ও বিচার ব্যবস্থার নয়, এটি একটি ভয়াবহ সামাজিক ও নৈতিক সংকট। অপরাধ বিজ্ঞানের বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ভুয়া মামলার ফলে একদিকে যেমন প্রকৃত অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে নিরপরাধ ব্যক্তিরা আইনকে অবিশ^াস করতে শিখবে। এতে সমাজে প্রতিশোধের মনোবৃত্তি ও অনাস্থার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়তে পারে। গণতন্ত্রে নাগরিকের অধিকার যেমন সুরক্ষিত হওয়া উচিত, তেমনি আইনের অপব্যবহার রোধেও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে পুলিশের, আদালতের এবং গণমাধ্যমের সম্মিলিত দায়িত্ব অপরিহার্য। তদন্ত কর্মকর্তাদের উচিত, সময়মতো তদন্ত করে নিরীহ ব্যক্তিদের অব্যাহতি নিশ্চিত করা, পাশাপাশি ভুয়া মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো-জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ তদন্ত, মামলার ‘সংখ্যার চাপে’ নয়, মান ও প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার এবং নিরপেক্ষ আইনি পরিবেশ। রাষ্ট্র যদি এই দায় পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু ব্যক্তি নয়, ন্যায়বিচারের ধারণাটিই চিরতরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button