চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড: নগরীর ছায়ায় অপরাধের বিস্তার

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি নগরী। কিন্তু সম্প্রতি এ নগরীতে ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের সক্রিয় উপস্থিতি এক ভয়াবহ বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, বালুমহাল ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ, হামলা ও খুনের মতো ভয়ংকর সব ঘটনার মাধ্যমে একের পর এক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন অংশে চলছে সংঘর্ষ, এমনকি গোলাগুলিও। অভিযোগ রয়েছে, এসব অপরাধের পেছনে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র, যাদের অনেকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় নতুন করে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী, যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঝুট ও পরিবহন ব্যবসা, এমনকি ব্যক্তিগত সম্পত্তিও। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও উদ্বেগজনক তথ্য-এই চক্রগুলোকে অনেকক্ষেত্রেই ঠেকাতে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে, বিশেষ করে যখন তাদের পেছনে থাকে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর মদদ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় রয়েছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং সংঘর্ষের মতো অপরাধগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবং নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়-অভিযান চললেও কেন অপরাধ দমন হচ্ছে না? কেন এই চক্রগুলো দিনের পর দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে? বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে অপরাধ চক্রগুলোর জটিল নেটওয়ার্ক, স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিশালী ব্যক্তিদের মদদ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। ফলে প্রশাসন একধরনের নিয়ন্ত্রিত সক্রিয়তা দেখালেও, অপরাধীদের থামানো যাচ্ছে না। বরং আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্রমেই এক অদৃশ্য শাসনব্যবস্থায় রূপ নিচ্ছে-যেখানে আইন, বিচার কিংবা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি শুধু নগরের নিরাপত্তা নয়, গোটা অর্থনীতিকেই হুমকির মুখে ফেলছে। বন্দরনগরী হিসেবে চট্টগ্রামের ওপর নির্ভরশীল দেশের বৃহৎ অংশ। এখানকার পরিবহন, শিল্প ও আমদানি-রপ্তানির নিরাপত্তা বিঘিœত হলে তার প্রভাব জাতীয় পর্যায়ে পড়বে নিঃসন্দেহে। তাই সময় এসেছে কঠোর অবস্থান নেওয়ার। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে প্রশাসনকে মুক্ত রেখে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করাই এখন জরুরি। চট্টগ্রামকে অপরাধমুক্ত রাখা কেবল আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি জাতীয় স্বার্থেরও অংশ। এই নগরীর শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে না পারলে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়েই। তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত, দৃঢ় এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পদক্ষেপ-যাতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছায়া থেকে মুক্তি পায় চট্টগ্রাম, ফিরে পায় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা।