শিল্প খাতের সংকট: কঠোরতার আগে সমঝোতা জরুরি

বর্তমানে দেশের শিল্পখাত এক অভূতপূর্ব সংকটে নিপতিত। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ডলারের অপ্রতুলতা, উচ্চ সুদের ঋণ, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক কড়াকড়িতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এরই মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ না করলে মালিকদের জেল পাঠানোর হুমকি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একদিকে বিনিয়োগে স্থবিরতা, অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের “শক্ত”অবস্থান-ফলে গোটা শিল্পখাত যেন এক “নরম গলায় কঠিন বাস্তবতা”র মাঝে দোল খাচ্ছে। বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেলের ভাষায়, “শিল্পোদ্যোক্তাদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে”-এ কথা হয়তো আবেগঘন, তবে এতে প্রতিফলিত হয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বাস্তব শঙ্কা। বিটিএমএ, বিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের অভিযোগ-জ্বালানির দাম বেড়েছে, উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ সরকার শুধু ফল চাইছে, কোনো উপায় দেখাচ্ছে না। গ্যাস নেই, কিন্তু বিল দিতে হবে। রপ্তানির প্রণোদনা কমে গেছে, অথচ বিশ^বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও চাপে। শিল্প মালিকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন-এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঈদুল আজহার আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, বন্ধ হয়ে যাবে অনেক শিল্পকারখানা, কর্মসংস্থান হারাবে লাখো মানুষ, আর তার প্রভাব পড়বে ব্যাংক খাতে-বাড়বে খেলাপি ঋণ, কমবে কর রাজস্ব। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ভাষার পরিবর্তে বাস্তবভিত্তিক সমাধানমূলক পদক্ষেপ জরুরি। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ যথার্থই বলেছেন-উৎপাদন ব্যয় বাড়লে প্রতিযোগিতা হ্রাস পায়, নতুন বিনিয়োগ থমকে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামগ্রিক অর্থনীতি। বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহ নেই বললেই চলে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রকল্প সংখ্যা কমেছে, অর্থের পরিমাণও সন্তোষজনক নয়। অথচ এই বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান, রপ্তানি ও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় কী? সংকটের বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। শিল্প ও ব্যবসার পরিবেশ রক্ষা করতে দ্রুত নীতিগত সংলাপ ও যৌথ সমাধান খুঁজতে হবে। এছাড়াও স্বল্পমেয়াদি নয়, দীর্ঘমেয়াদি শিল্প নীতি প্রণয়ন করতে হবে-যেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, মুদ্রানীতি ও কর কাঠামো একসঙ্গে সমন্বিত হবে। শিল্পখাত কেবল একটি খাত নয়; এটি কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। তাই শিল্পবিরোধী মনোভাব নয়, শিল্পবান্ধব রাষ্ট্রীয় মানসিকতা জরুরি। সরকার যদি শিল্পকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখে, তাহলে সেটিকে রক্ষা করাও তার দায়িত্ব। কোনো বেতন-ভাতা পরিশোধ না করলে জেল-এমন কৌশল যেন শেষ অস্ত্র হয়, প্রথম নয়। একটি সমন্বিত, বাস্তবমুখী, মানবিক শিল্পনীতির মধ্য দিয়েই কেবল এই ভয়াবহ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সংকটে শিল্প নয়, সংকটে রাষ্ট্র-এ উপলব্ধি যত দ্রুত হবে, ততই মঙ্গল।