সম্পাদকীয়

বাল্যবিয়ে: নতুন করে পুরোনো আতঙ্কের প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোয় দীর্ঘদিন ধরে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা হয়ে টিকে আছে বাল্যবিয়ে। একে প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ, জনসচেতনতা, এমনকি আইনানুগ পদক্ষেপ থাকলেও, সাম্প্রতিক চিত্র বলে দেয়-আমরা যেন আবার পিছিয়ে পড়ছি। উদ্বেগের বিষয়, এখন আর বাল্যবিয়ে হয় গোপনে নয়; হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়, প্রকাশ্যেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশে, যা এক বছরের ব্যবধানে ১.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এই প্রবণতা বেশি হলেও শহরও এর বাইরে নয়। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান আরও স্পষ্টভাবে এ সংকটের মাত্রা তুলে ধরে-চার বছরে বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে ১০৬ জন ছাত্রী, প্রধানত বাল্যবিয়ের কারণে। এর পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান। দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা ও কুসংস্কার যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী সামাজিক অনুকরণ ও প্রশাসনিক শৈথিল্য। আগে প্রশাসনের ভয়ে যা গোপনে হতো, এখন তা খোলাখুলিভাবে হচ্ছে। ২০২৩ সালের আগস্টের পর থেকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম হ্রাস পাওয়া এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এতে অনুঘটকের কাজ করছে। এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো-বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা অনেক সময় একাধিকবার বিয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। বিয়ের পর সংসার ভেঙে গেলে তাদের জীবনে শুরু হয় এক অন্ধকারচক্র, যেখানে শিক্ষার সুযোগ, স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যায়। সরকারি ‘১০৯’ হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা বাড়ছে, যা জনসচেতনতার এক ইতিবাচক দিক হলেও, এর পেছনে লুকিয়ে আছে একটি ভয়ংকর বাস্তবতা-বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ে এখনো কার্যকর কাঠামো তৈরি হয়নি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই কলসেন্টারের মাধ্যমে ১০ হাজারের বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামগ্রিক প্রবণতা রোধে তা পর্যাপ্ত নয়। সমাধান কোথায়? প্রশাসনকে মানসিকভাবে প্রস্তুত ও সক্রিয় করতে হবে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা কাঠামোগত দুর্বলতা এই মৌলিক সামাজিক সমস্যার প্রতিকারে যেন বাধা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও কিশোর-কিশোরী ক্লাবসহ গ্রামীণ পর্যায়ের সামাজিক সংগঠনগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু এবং ঝরে পড়া ছাত্রীদের পুনঃভর্তির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা, এই লড়াই শুধু প্রশাসনিক নয়-এটি একান্তভাবেই সামাজিক। প্রতিটি পরিবারকে বোঝাতে হবে, বাল্যবিয়ে নয়-শিক্ষা ও সুরক্ষাই কন্যাসন্তানের ভবিষ্যৎ। নইলে কন্যাশিশুর সম্ভাবনা বারবারই খুন হবে সমাজের সম্মিলিত নীরবতায়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button