তিস্তা: প্রতিশ্রুতির নদী, অবহেলার বাস্তবতা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদী যেন প্রতি বছর নতুন করে এক মহাবিপর্যয়ের নাম হয়ে ওঠে। ভাঙন, বন্যা, বাস্তচ্যুতি, ফসলহানি ও আর্থিক ক্ষতির এক দীর্ঘ তালিকা যেন নদীটির নিয়তির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অথচ এক দশক ধরে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার কথাই কেবল শোনা যাচ্ছে, বাস্তবায়নের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা সংস্থা ও নদী রক্ষা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিগত ১০ বছরে তিস্তার ভাঙনে বাস্তচ্যুত হয়েছেন চার লাখের বেশি মানুষ। ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ। নদীর বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনপ্রবণ, যার ২১ কিলোমিটার ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত। এই ভয়াবহতা শুধু পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে রয়েছে হাজারো পরিবারের অসহায়ত্বের গল্প। গঙ্গাচড়ার চরাঞ্চলের মানুষদের মতো অনেকেই ৫-৬ বার বসতভিটা হারিয়ে বাধ্য হয়েছেন দিনমজুরের জীবন বেছে নিতে। যাঁরা একসময় দান করতেন, আজ তারা অন্যের অনুগ্রহে বেঁচে আছেন। অথচ প্রতিবছর ভাঙন রোধে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা যথাযথ পরিকল্পনা থাকলে হয়তো এখন পর্যন্ত একটি টেকসই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগ ফেলা বা স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পের চক্র যেন বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। সমস্যা রয়ে গেছে সেই জায়গাতেই: সংকট মোকাবেলায় কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের অভাব। এই প্রেক্ষাপটে নদী গবেষক ও তিস্তা আন্দোলনের কর্মীরা একাধিক বাস্তবমুখী প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিস্তা সমস্যার একটি আন্তর্জাতিক দিক রয়েছে। প্রতি বছর ভারত থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ অংশে বন্যা দেখা দেয়। এ নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে কার্যকর প্রতিবাদ বা সমাধানের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল দুই কোটির বেশি মানুষের ভাগ্য যেন আটকে আছে অনিশ্চয়তার ¯্রােতে। প্রতি বছর তারা শুনছেন ‘মহাপরিকল্পনার’ কথা, কিন্তু দেখছেন কেবল নদীগর্ভে বিলীন হওয়া ঘরবাড়ি আর ফসলের মাঠ। এই অবস্থায় এখন সময় এসেছে প্রতিশ্রুতির ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবায়নের পথে হাঁটার। তিস্তা রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন, আন্তঃদেশীয় পানি বণ্টন নিয়ে নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই। নাহলে তিস্তা শুধু একটি নদীর নামই থাকবে না, হয়ে উঠবে একটি স্থায়ী মানবিক সংকটের প্রতীক।