সম্পাদকীয়

লবণচাষির ঘামে উৎপাদন, লাভ কোথায়?

দেশজুড়ে যখন বর্ষা নেমে এসেছে, তখন উপকূলের মাঠজুড়ে থেমে গেছে লবণ উৎপাদনের চাকা। চলতি মৌসুমে ২২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়েছে, যা ৬৪ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অথচ এই সাফল্যের আড়ালে চাপা পড়ে আছে হাজার হাজার লবণচাষির হতাশা ও আর্থিক ক্ষতির গল্প। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে ৬৯ হাজার একরেরও বেশি জমিতে লবণ চাষ করে জীবনধারণ করেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। তাদের শ্রমেই গড়ে ওঠে দেশের প্রয়োজনীয় লবণের ভা-ার। এবারও উৎপাদন লক্ষ্য ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন, অর্জিত হয়েছে ২২ লাখ টনের বেশি। অথচ চাষিরা জানাচ্ছেন, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে তাদের খরচ পড়ে ৩০০ টাকারও বেশি, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের জন্য তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য, বরং ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এই বৈষম্যের চিত্র আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, মাঠ পর্যায়ে প্রতি কেজি লবণের দাম ৬.৫-৭ টাকা হলেও বাজারে প্যাকেটজাত লবণের দাম ৩০-৪৫ টাকা পর্যন্ত। এই বিস্তর মূল্যবৈষম্য থেকে চাষিরা পান না কোনো অংশীদারিত্ব। লাভ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেটে। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমানে চাষিদের হাতে ১৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে, যা দিয়ে আগামী ৭-৮ মাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। সুতরাং আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে-যখন চাষিদের ঘরেই পর্যাপ্ত লবণ মজুত, তখন কেন তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না? এখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ঘাটতি চোখে পড়ে। ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ, বাজারে সরাসরি চাষিদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো-এইগুলো এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় প্রতি বছর উৎপাদন বাড়লেও প্রান্তিক চাষিরা হয়ে পড়বেন আরও ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুৎসাহিত। লবণ উৎপাদন শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতিরও অংশ। এই পেশায় নিয়োজিত পরিবারগুলোর রুটি-রুজির নিশ্চয়তা না থাকলে ভবিষ্যতে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। প্রয়োজন একটি টেকসই ও ন্যায্য বাজার কাঠামো, যাতে উৎপাদনের প্রকৃত মূল্য চাষির ঘরে পৌঁছায়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান, লবণ চাষিদের ঘামের মূল্য যেন ক্ষতির হিসেব না হয়, তা নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হোক এখনই।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button