সম্পাদকীয়

অটোপাস ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে শিক্ষার ভিত্তি ভেঙে পড়ছে

করোনা মহামারি শুরুর পর বিশ^জুড়েই শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু মহামারিকালীন অটোপাস ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাস নামের যে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, তা পরবর্তীতে প্রায় নিয়মিত পন্থায় পরিণত হয়। দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা এই ব্যবস্থা এখন শিক্ষার মানে এমন এক শূন্যতা তৈরি করেছে, যা পুরো প্রজন্মের জন্যই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলছে। বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এই সংকটের প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ইউনিটে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই ফেল করেছে, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেও অনুত্তীর্ণদের হার ৯০ শতাংশের বেশি। আশ্চর্যের বিষয় হলো-এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। এ চিত্র শুধু একটি বছর বা একটি ব্যাচের নয়; বরং ২০২০ সাল থেকে টানা কয়েক বছর ধরেই একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাবিদদের ভাষায়, এটি এক ভয়াবহ “শিখন শূন্যতা”। পরীক্ষা পদ্ধতিতে নম্বর পাওয়ার সহজসাধ্য পথ তৈরি হলেও, প্রকৃত শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের সুযোগ হয়নি বললেই চলে। করোনাকালীন জরুরি পরিস্থিতিতে সীমিত সময়ের জন্য অটোপাস কিংবা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস গ্রহণযোগ্য হলেও, সেটিকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চালু রাখা মোটেই দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত ছিল না। শিক্ষা শুধু পাস নম্বর বা সনদ অর্জনের নাম নয়, বরং এটি চিন্তা, বিশ্লেষণ, দক্ষতা ও চারিত্রিক বিকাশের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়াকে শর্টকাটে চালাতে গিয়ে আমরা আজ এক অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উপাচার্যরা যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা শুধু ব্যক্তিগত মত নয়-বরং জাতীয় শিক্ষানীতির জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। যেসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা স্তরে পৌঁছেও মৌলিক বিষয় বুঝতে হিমশিম খায়, তারা ভবিষ্যতে কর্মজীবনে কতটা কার্যকর হবে-সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। শিক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে এখনই শিখন শূন্যতা পূরণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ‘রিকোভারি লার্নিং প্রোগ্রাম’ চালু করা যেতে পারে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও নবাগত শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ব্রিজ কোর্স’ বা ‘স্কিল রিফ্রেশমেন্ট প্রোগ্রাম’ চালুর কথা ভাবা উচিত। শুধু ফলাফলের হার নয়, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রকৃত অর্থে দক্ষ ও জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলা। কেননা, শিক্ষায় শিকড় দুর্বল হলে রাষ্ট্রের ভিতও নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button