দুর্নীতি ও বৈষম্যের চিত্রে নাগরিক অভিজ্ঞতা: সুশাসনের প্রশ্ন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে দেশের সরকারি সেবা খাত এবং বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে নাগরিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির এক গুরুতর চিত্র তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১৬-এর আলোকে পরিচালিত এ জরিপ বলছে, গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এ হার শুধু পরিসংখ্যানের সংখ্যা নয়, এটি দেশের সুশাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা ও জনআস্থার সংকটের স্পষ্ট প্রতিফলন। বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বিআরটিএ (৬৩.২৯%), আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৬১.৯৪%), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%) এবং ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে (৫৪.৯২%) দুর্নীতির মাত্রা। এসব সেবা এমন সব খাত যেখানে নাগরিকদের জীবনের মৌলিক চাহিদা বা অধিকার জড়িত। সাধারণ মানুষ যখন সেবা নিতে গিয়ে বাধ্য হন ঘুষ দিতে, তখন নাগরিক-রাষ্ট্র সম্পর্কেই আঘাত লাগে। দুর্নীতির পাশাপাশি বৈষম্যের চিত্রও উদ্বেগজনক। দেশের ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষ গত এক বছরে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, যেখানে নারীদের মধ্যে এ হার ১৯.৬২ শতাংশ, যা পুরুষদের (১৮.৯৭%) তুলনায় কিছুটা বেশি। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বেশি, যা আর্থসামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গভেদজনিত বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। পারিবারিক পরিসরে, গণপরিবহণ ও কর্মস্থলে বৈষম্য বা হয়রানির মাত্রা উচ্চ, অথচ এর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন বা অভিযোগ জানানোর হার মাত্র ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ-যা একধরনের নীরবতা ও ভীতির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষণ। জরিপে দেখা যায়, বিচারব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছেন বিরোধে জড়ানো ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিক, তবে আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার তুলনায় অনানুষ্ঠানিক উপায়ে নিষ্পত্তির প্রবণতা বেশি। এটি রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার জটিলতা, ধীরগতি এবং নাগরিক আস্থাহীনতার প্রতিফলন হতে পারে। এই চিত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, এবং সমঅধিকারের প্রশ্নে এখনও অনেক পথ বাকি। ঘুষ-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিলে যে কোনো উন্নয়নই অব্যাহত বৈষম্যের কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে। সুশাসনের অনুপস্থিতি দেশের ভেতরেই এক ধরনের অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। এ অবস্থায় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি, নারীদের প্রতি বৈষম্য রোধে কার্যকর আইন বাস্তবায়ন এবং বিচারপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ ও বিশ^াসযোগ্য করা। নাগরিকের সম্মানজনক জীবনধারা নিশ্চিত করাই প্রকৃত উন্নয়নের মানদ- হওয়া উচিত-পরিসংখ্যান নয়, বাস্তবিক পরিবর্তনই এর মাপকাঠি।