এনটিআরসিএ ও শিক্ষক নিয়োগ: প্রহসনের প্রতিচ্ছবি?

দেশে তরুণদের সবচেয়ে বড় স্বপ্নগুলোর একটি-একটি স্থায়ী চাকরি। বিশেষত মেধাবী ও শিক্ষিত প্রজন্ম যখন শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি নেয়, সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে, তখন সে স্বপ্নের প্রতিদান হওয়া উচিত স্বচ্ছ ও সুবিচারভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)-এর সাম্প্রতিক কর্মকা- দেখে সেই স্বপ্নেরই যেন অপমৃত্যু ঘটছে। সম্প্রতি ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর থেকেই রাজধানীতে প্রতিদিন আন্দোলন করছেন হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী। পুলিশের লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড, রাস্তায় অবস্থান, বৃষ্টিতে ভেজা শরীর-সব মিলিয়ে বিক্ষোভের দৃশ্য যেন একটি অসুস্থ নিয়োগ ব্যবস্থার চিত্রকথা বলে। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ গুরুতর: মৌখিক পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নেই, প্রশ্ন ছিল অবান্তর, নম্বর দেওয়া হয়েছে পক্ষপাতমূলকভাবে, এবং ৪০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েও অনেক প্রার্থীকে ‘ফেল’ দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২৩ হাজারের বেশি প্রার্থীকে মৌখিক পর্বেই বাদ দেওয়ার ঘটনা বিস্ময়কর। এই প্রশ্নও উঠছে: যেখানে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর নির্ধারিত মাত্র ২০, সেখানে কি সত্যিই এত বিপুল সংখ্যক প্রার্থী অকৃতকার্য হতে পারে? এই প্রেক্ষাপটে এনটিআরসিএর ভূমিকা ও দায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ প্রদানে নির্ধারিত নিয়ম পরিবর্তন করেছে কি না, তা এখন খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। একইসঙ্গে চাকরিপ্রার্থীরা যে আরও একটি স্পষ্ট অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলেছেন-তা হলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে যারা আবেদন করেছেন, তাদের বয়স গণনা করা হয়েছে ২০২৫ সালের ৪ জুন (ফল প্রকাশের দিন) অনুযায়ী! এতে করে অনেক আবেদনকারী বয়সসীমার বাইরে পড়ে গেছেন-যা অমানবিক এবং প্রশাসনিক বিচারে দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত বলেই বিবেচিত। চূড়ান্ত ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, বয়স নির্ধারণে অসঙ্গতি, স্বচ্ছতাহীন মৌখিক পরীক্ষা এবং গণহারে ফেল-সব মিলিয়ে এনটিআরসিএ নিজেই নিজের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে। তরুণদের স্বপ্নের সঙ্গে এমন প্রহসন চালিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকে, তবে তা শিক্ষাক্ষেত্রের ভবিষ্যৎকেও বিপন্ন করবে। চাকরিপ্রার্থীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে প্রক্রিয়া চালালে আস্থা হারাবে জনসাধারণ, প্রশ্নবিদ্ধ হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে নিয়োগে অনিয়ম-অসঙ্গতির বিষয়গুলো পরিষ্কার করা প্রয়োজন। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এমন অনভিপ্রেত পরিস্থিতি যাতে আর না হয়, তা নিশ্চিত করাও জরুরি। শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়োগ কোনো আমলাতান্ত্রিক কৌশলের খেলা নয়-এটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের হাতিয়ার। সেই অস্ত্রের ক্ষয় হওয়া মানে জাতির সম্ভাবনার মৃত্যু।