পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু-নীরব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে

রংপুরে শিশুমৃত্যুর একটি মর্মান্তিক প্রবণতা ভয়াবহ আকার নিচ্ছে-পানিতে ডুবে মৃত্যু। যে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য, সেই মৃত্যু এখন নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে। বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা, জলাবদ্ধ গর্ত কিংবা নদী-শিশুদের জন্য বিপজ্জনক ফাঁদে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অভিভাবকদের সামান্য সচেতনতার অভাব, অব্যবস্থাপনা এবং নজরদারির ঘাটতি এই করুণ পরিণতির মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে রংপুরের পাঁচ উপজেলায় ১১১ জন শিশুর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। অথচ সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। কারণ অনেক শিশুর মৃত্যুই আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যও আশঙ্কাজনক। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নিখোঁজ ৩৫ শিশুর মধ্যে মাত্র ১৯ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। এই চিত্র শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একটি পরিবার, একটি অসমাপ্ত শৈশব, একটি অপূরণীয় ক্ষতি। এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক সত্য হলো-এগুলো ছিল রোধযোগ্য। স্থানীয় সমাজকর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও একমত যে, সচেতনতার অভাবই শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। অতীতে মায়েরা সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত নজরদার ছিলেন। অথচ আধুনিক ব্যস্ত জীবনে অনেক মা-বাবা প্রযুক্তিতে ব্যস্ত, সন্তান কোথায় খেলছে বা কী করছে-সেই খোঁজ রাখছেন না। এ অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজন একাধিকমুখী উদ্যোগ। পরিবারভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে গ্রাম ও শহরে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। স্কুলে, কমিউনিটি সেন্টারে, মসজিদ-মন্দিরে কিংবা ইউনিয়ন অফিসে শিশু নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা, লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং ইত্যাদি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও বসতবাড়ির আশপাশে অব্যবহৃত পুকুর-ডোবা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা ব্যারিকেড দেওয়া বা ভরাট করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে একটি নীতিগত কাজ হিসেবে দেখতে হবে। পাশাপাশি জরুরি প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে পাড়া-মহল্লার মানুষদের। ফায়ার সার্ভিসকে আরও সক্রিয় করতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ধার ও উদ্ধার-পরবর্তী সেবা প্রসারিত করে। সর্বোপরি, শিশু মৃত্যু কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়-এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। কারণ, প্রতিটি শিশুই আমাদের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ যেন অনাহূত মৃত্যুর অন্ধকারে নিভে না যায়, সেটাই হওয়া উচিত সরকারের, সমাজের ও প্রতিটি অভিভাবকের সম্মিলিত অঙ্গীকার।