রাজস্ব ঘাটতির বৃত্তে বাজেট: কাক্সিক্ষত সংস্কার কোথায়?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের ধারাবাহিক ঘাটতি এখন আর কেবল একটি হিসাবগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীরতর অসংগতি এবং দীর্ঘদিনের সংস্কারহীনতার প্রতিচ্ছবি। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা সত্ত্বেও রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি-এটি আমাদের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য এক জোরালো সতর্কবার্তা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে এনবিআরের কাঁধে পড়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটির দায়িত্ব। অথচ বিগত অর্থবছরে ১১ মাস শেষে ৬৬ হাজার কোটিরও বেশি ঘাটতি নিয়ে এনবিআর বছরের শেষ মাসে প্রায় অসম্ভব এক লক্ষ্য অর্জনের চাপে পড়ে। এমন উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগও অমূলক নয়। সিপিডি এবং টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট যে, করজাল সম্প্রসারণ ও আদায়ে টেকসই সংস্কার ছাড়া রাজস্ব ঘাটতির এই বৃত্ত থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য পাল্টা শুল্ক, শুল্ক রেয়াত হ্রাস, এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে করভার বৃদ্ধির প্রভাব রাজস্ব আদায়কে আরো জটিল করে তুলবে। দৈনিক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আয়কর, ভ্যাট, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক-সব খাতেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। আয়কর খাতে প্রায় ৩৭ শতাংশ, ভ্যাটে প্রায় ২৭ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানিতে ২৩ শতাংশ ঘাটতি ¯্রফে প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, এটি একটি কাঠামোগত ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রযুক্তিনির্ভর কার্যকর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং করনীতি গ্রহণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে চিহ্নিত করা যায়। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন-ডিজিটাল করব্যবস্থা, কর ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ, রাজস্ব প্রশাসনের জবাবদিহিমূলক সংস্কার এবং করদাতার প্রতি বন্ধুবান্ধব মনোভাব ছাড়া এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর অতিরিক্ত করভার না চাপিয়ে করজাল বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আহরণে ভারসাম্য আনতে হবে। এ দেশে কর আদায়ের হার এখনও জিডিপির মাত্র ৭-৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও এটি উদ্বেগজনক ভাবে কম। তবুও প্রতি বছর উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়-এ যেন ‘আশাবাদী সংখ্যার বাজেট’, যার বাস্তবায়নে থাকে না পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বা কাঠামোগত ভিত্তি। সরকারের সামনে এখন সময় এসেছে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের। স্বল্পমেয়াদি ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মরিয়া চেষ্টা’ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কর সংস্কার, কর প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের কর প্রদানে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ জরুরি। অন্যথায়, রাজস্ব ঘাটতির এই ধারাবাহিকতা কেবল বাজেট বাস্তবায়ন নয়, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলবে।