সম্পাদকীয়

চিথলিয়ায় নদীভাঙন: প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানবিক ব্যর্থতা

প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির এক চেনা চিত্র। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার চিথলিয়া গ্রামে শৈলদহ নদীর ভয়াবহ ভাঙন তার সর্বশেষ উদাহরণ। ইতোমধ্যে ৭৬ মিটার এলাকাজুড়ে ভাঙনের ফলে বিলীন হয়েছে পাকা সড়কের একটি অংশ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজ। হুমকির মুখে রয়েছে প্রায় ৬০টি বসতবাড়ি, শত শত বিঘা ফসলি জমি, গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থাপনা, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং পানির ট্যাংকসহ অসংখ্য স্থাপনা। অথচ এ অঞ্চলের জনগণ দিনের পর দিন নদীর ভাঙন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছে-ভাঙনের কিনারে দাঁড়িয়ে। শুধু অবকাঠামোই নয়, বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন, জীবিকা ও মানসিক নিরাপত্তা। রেবা রানী ম-লের আতঙ্ক-“বাড়ি কখন নদীতে বিলীন হয়, সে আতঙ্কে রাতে ঘুম আসে না”-কোনো ব্যক্তির একক উদ্বেগ নয়; এটি গোটা নদীতীরবর্তী জনপদের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা। এ পরিস্থিতি আর শুধু একটি গ্রামের দুর্যোগ নয়, বরং এটি স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নদী রক্ষা ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভাঙনপীড়িত এলাকা পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে ৭৬ মিটার প্রতিরক্ষা চাহিদা পাঠিয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৪৮ মিটার অনুমোদন পেয়েছে। প্রশ্ন হলো, প্রাথমিক অবহিতির পরও কেন সময়মতো পূর্ণাঙ্গ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? কেনই বা জরুরি প্রকল্পের অনুমোদনে এত দীর্ঘসূত্রিতা? চিথলিয়া দিয়ে যে সড়কটি ডুমুরিয়া বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটি ১০টি গ্রামের অন্তত ১৫ হাজার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র উপায়। ব্রিজ ধসে যাওয়া, সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হওয়া শুধুই অবকাঠামোগত ক্ষতি নয়-এটি জনজীবনের স্বাভাবিক গতিকে অবরুদ্ধ করে, বন্ধ করে দেয় শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক প্রবাহ। শিশুদের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে কৃষকের ফসল পরিবহন পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকা- আজ হুমকির মুখে। আমরা লক্ষ্য করছি, নদীভাঙন এখন মৌসুমি দুর্যোগের চেয়ে বেশি একটি নীতিগত ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সময়মতো জিও ব্যাগ ফেলা, বাঁধ নির্মাণ, নদীতীর সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই অনেক ভাঙন রোধ করা সম্ভব। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ চাহিদা পাঠানো, ফাইল ঘোরানো এবং প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় থেমে থাকে। এই অব্যবস্থাপনা এবং অনুপযুক্ত পদক্ষেপের মূল্য দিতে হয় নদীপাড়ের মানুষদেরই-তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা এবং জীবনের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায় ¯্রােতের সাথে। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কি শুধু শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নেই ব্যস্ত থাকবে, নাকি এসব প্রান্তিক জনপদের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসবে?

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button