রেলক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ: কবে আসবে জবাবদিহির সময়?

বাংলাদেশে রেলপথ দীর্ঘদিন ধরে একটি নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবতা বলছে, রেলক্রসিং ও রেললাইনের নিরাপত্তা আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে রেললাইনের ওপর ঘটে যাচ্ছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাওলা রেলগেটে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় অংকিতা মজুমদারের মৃত্যু, কিংবা ২ মে খিলক্ষেতে এক যুবকের করুণ পরিণতি-এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি স্থায়ী ব্যর্থতার ফল। সেই ব্যর্থতা ব্যক্তিগত অসচেতনতার যেমন, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনাও দায়মুক্ত নয়। ঢাকার কুড়িলে ট্রেনের ভিডিও করতে গিয়ে এক তরুণের মৃত্যু বা মিরসরাইয়ে রেললাইনে বসে গল্প করার সময় তিন বন্ধুর প্রাণ হারানো-এসব ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে দেশের রেলপথ। এক জরিপ বলছে, দেশের ৭৯ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত। রেলওয়ের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২ হাজার ৮৫৬টি রেলক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই অনুমোদন নেই। অবাক করা বিষয় হলো, অনুমোদিত ১ হাজার ৪৯৫টি রেলক্রসিংয়েরও অর্ধেকের বেশি গেটম্যানবিহীন। মাত্র ২৪২টি ক্রসিংয়ে রয়েছে রেলের স্থায়ী রক্ষী। এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট, দেশের রেলক্রসিংগুলো একেকটি “মৃত্যুফাঁদ” হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের রেল দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশই ঘটছে লেভেল ক্রসিংয়ে। গত চার বছরে রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১ হাজার মানুষ, আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি। এটি কোনো সাধারণ বিপর্যয় নয়; এটি একটি নীতিগত ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার নমুনা। রেল নিরাপত্তা রক্ষায় আইন থাকলেও তা কার্যত অকার্যকর। বাংলাদেশ রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট পর্যন্ত এলাকা ১৪৪ ধারা জারিকৃত এলাকা হিসেবে গণ্য হলেও, বাস্তবে এটি মানা হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই, সাধারণ মানুষও এই আইন সম্পর্কে জানে না বা সচেতন নয়। এমন একটি শূন্যতার মধ্যে জন্ম নেয় মৃত্যুর সুযোগ। বিশেষজ্ঞরা বারবারই সাবধান করে আসছেন: অবৈধ রেলক্রসিং বন্ধ, অনুমোদিত ক্রসিংয়ে গেট ও গেটম্যান নিশ্চিতকরণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি, এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া রেলপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এসব কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও, বাস্তবায়নের অভাব গোটা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন রেলপথে নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে প্রযুক্তিনির্ভর অ্যালার্ম ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় গেট, গেটম্যান নিয়োগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রেলপথ কারও মৃত্যু ফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে না-এই নীতিগত অবস্থান থেকেই শুরু হওয়া উচিত রেলপথ সংস্কারের পথচলা। না হলে প্রতিদিনই নতুন করে লেখা হবে করুণ সব মৃত্যুগাথা, আর আমরা কেবল নীরব সাক্ষী হয়ে থাকব।