সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনার ছোবল

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি বরং জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি স্থায়ী ও বিপজ্জনক হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বর্ষা শুরু হতেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে বরিশাল বিভাগ, বিশেষত বরগুনা জেলায়, যেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য এবং অনেকটাই প্রতিক্রিয়াশীল। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে ‘দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া’-কে দায়ী করা হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামোই নেই। বরগুনার হাসপাতালগুলোয় রোগীর তুলনায় শয্যা কম, চিকিৎসক ও নার্স সংকট প্রকট। দুই দফায় বাড়তি জনবল ও অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হলেও তাতে পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে-এ প্রস্তুতি আগে থেকেই কেন নেওয়া হলো না? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত মঙ্গলবারের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আরও তিনজন মারা গেছেন এবং ৪২৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট, সংক্রমণের গতি কমছে না। অথচ, প্রতিটি বর্ষা মৌসুমেই এই রোগের আগ্রাসনের পূর্বাভাস জানা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-কোনো পক্ষ থেকেই সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের চিত্র দেখা যায় না। এতে বোঝা যায়, সমস্যা শুধুমাত্র জনসচেতনতার ঘাটতিতে নয়, বরং নীতিগত উদাসীনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতায়ও। যেখানে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও নিয়মিত ফগিং, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, পানি জমার স্থান শনাক্তকরণ ও ধ্বংস, এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জরুরি-সেখানে দেখা যায় বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম, যা কেবল সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল মাত্র। প্রতিবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু এখন যেন এক প্রকার ‘গৃহীত বাস্তবতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অধিকাংশ রোগী পুরুষ হলেও নারী এবং শিশুরাও ঝুঁকির বাইরে নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে নিচু এলাকাগুলোতে পানির নিষ্কাশন, আবর্জনা পরিষ্কার ও ওষুধ ছিটানো কার্যক্রমকে গতি দিতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল, পর্যাপ্ত আইসোলেশন শয্যা ও ওষুধ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-সবার আগে সরকারকে স্বীকার করতে হবে, ডেঙ্গু একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। কেবল মৃত্যুর সংখ্যা নয়, জনগণের দুর্ভোগের পরিমাণও আমাদের ব্যর্থতার মাপকাঠি। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু এখন সারা বছরই দেখা দিতে পারে, তাই এটিকে ‘মৌসুমি সমস্যা’ ভাবা থেকে সরে এসে সারা বছরব্যাপী কার্যকর, টেকসই ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button