সম্পাদকীয়

খেলনার মোড়কে বিষ-শিশুর জন্য নীরব বিপদ

একটি খেলনা শিশুর হাতে মানে শুধুই খেলা নয়, তার শৈশবের নিরীহ আনন্দ, শেখার প্রাথমিক মাধ্যম এবং নিরাপদ এক আশ্রয়। কিন্তু সেই খেলনাই যদি হয়ে ওঠে বিষাক্ত উপাদানে পূর্ণ এক নীরব ঘাতক, তাহলে তা নিছক ভোগ্যপণ্যের সীমা পেরিয়ে যায়-এটি হয়ে ওঠে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সংকট। সম্প্রতি পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নমূলক সংগঠন এসডো প্রকাশিত গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই এক ভয়াবহ চিত্র। তাদের তথ্যমতে, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া শিশুদের প্লাস্টিক খেলনার ৭০ শতাংশেই রয়েছে অতিমাত্রায় বিষাক্ত ভারী ধাতু, যার মাত্রা আন্তর্জাতিক নিরাপদ সীমার চেয়ে ১০ থেকে ৭০ গুণ পর্যন্ত বেশি। সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামের মতো উপাদান এসব খেলনায় রয়েছে এমন উচ্চমাত্রায়, যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ, শেখার ক্ষমতা, কিডনি কার্যক্রম এবং আচরণগত বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এসডো ও আন্তর্জাতিক সংস্থার এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার চকবাজার থেকে সংগৃহীত নমুনার মধ্যে উজ্জ্বল রঙের খেলনায় সবচেয়ে বেশি বিষাক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি স্থানীয় ব্র্যান্ড-আমান টয় গার্ডেন, খোকন প্লাস্টিক প্রোডাক্টস ও শাহজালাল টয়স গ্যালারি-যাদের শতভাগ নমুনা নিরাপদ সীমা ছাড়িয়েছে। একেকটি খেলনায় সিসার মাত্রা পাওয়া গেছে ২৩৫০ পিপিএম, যেখানে আন্তর্জাতিক সীমা মাত্র ৯০ পিপিএম। পারদের মাত্রা ১০৮০ পিপিএম, যা স্বাভাবিকের ১৮ গুণ বেশি। এর চেয়ে উদ্বেগজনক হলো, এই খেলনাগুলো বিশেষভাবে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি-যারা খেলনা মুখে নেওয়ার প্রবণতায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির মাত্রাতেই থেমে থাকে না এই সংকট। গবেষণায় দেখা গেছে, এই খেলনার বর্জ্য মিশে যাচ্ছে পরিবেশে-মাটি, পানি ও খাবারের মাধ্যমে ফিরে আসছে মানবদেহে। বিষাক্ত উপাদান বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে একটি প্রজন্মের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে একটি জাতীয় দুর্যোগে রূপ দিতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই খেলনাগুলো বাজারে অবাধে প্রবেশ করছে? বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন -এর মতো প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত বড় একটি জনস্বাস্থ্য হুমকি এড়িয়ে যাচ্ছে? প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারকদের দায় যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিষ্ক্রিয়তাও এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। যেখানে শিশুর মুখে যাওয়া প্রতিটি উপাদান নিয়ন্ত্রণে রাখতে উন্নত বিশে^ রয়েছে কঠোর আইন ও মনিটরিং ব্যবস্থা, সেখানে আমাদের দেশে সেই তদারকির অভাব রীতিমতো উদ্বেগজনক। শুধু খেলনার রঙিন মোড়ক নয়, এর প্রতিটি উপাদান পরীক্ষা করে দেখা জরুরি-কারণ শিশুর হাতে একটি ক্ষুদ্র বস্তুও তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার কিংবা ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এখন আর প্রতীক্ষা নয়-এই সংকট মোকাবেলায় অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button