বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত: আস্থার সংকট না কাঠামোগত ব্যর্থতা?

সম্প্রতি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের এক রিপোর্টে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (স্কোর: ৯.০) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতের জন্য এক সতর্কবার্তা। বিশ^খ্যাত এই রেটিং সংস্থার “বিআইসিআরএ” প্রতিবেদন শুধু স্কোর নির্ধারণ করেনি, বরং এর পেছনের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং নীতিগত সংকটের কথাও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে। এসব ব্যাংকে অনিয়ম, তারল্য ঘাটতি, জালিয়াতি এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার অভিযোগে কর্মকর্তাদের অপসারণ ও বোর্ড পুনর্গঠন হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জরুরি হলেও, এটি আস্থার সংকটের গভীরতা প্রকাশ করে। এই পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে এলেও, মূল সমস্যা যে গভীরে প্রোথিত-তা অস্বীকার করার উপায় নেই। খেলাপি ঋণ, দুর্বল করপোরেট গভার্নেন্স, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং জবাবদিহিহীনতা-এই উপাদানগুলো গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকিং খাতকে আস্থাহীনতার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। ফলে, শুধু নীতিগত নয়, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই খাতকে টেকসই ভিত্তিতে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তবে পুরো চিত্র একপাক্ষিক নয়। এসঅ্যান্ডপি প্রতিবেদনে “অর্থনৈতিক ঝুঁকির ধারা” ও “সিস্টেম-ওয়াইড ফান্ডিং” সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হিসেবে উঠে এসেছে। এর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর্থক ভূমিকা যেমন প্রশংসার দাবিদার, তেমনি কিছু মৌলিক অর্থনৈতিক সূচকের স্থিতিশীলতাও দায়ী। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি আমানতের প্রবৃদ্ধি, প্রবাসী আয় এবং বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে। তবে প্রশ্ন হলো-এতসব ব্যবস্থা কি দীর্ঘমেয়াদে যথেষ্ট? অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, সময়মতো কাঠামোগত সংস্কার না এলে ব্যাংকিং খাত এক ধরনের দৃষ্টিকটুভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা’র মধ্যে রয়ে যাবে। রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি গঠনমূলক আর্থিক খাত গড়ে তোলা ছাড়া ভবিষ্যতের কোনো টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে দরকার তিনটি বিষয়: স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিচালনব্যবস্থা। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং স্বশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে একটি বলিষ্ঠ, দক্ষ ও আস্থাশীল ব্যাংকিং খাতই পারে দেশের অর্থনীতিকে আগামী দিনে এগিয়ে নিতে। নতুবা আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে উন্নতি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।