সম্পাদকীয়

সমন্বয়কের মুখোশে মাদক সিন্ডিকেট: নীরব বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি

দেশজুড়ে মাদকের বিস্তার নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে তরুণদের একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী যে পরিসরে মাদক ব্যবসাকে সংগঠিত ও বিস্তৃত করেছে, তা কেবল উদ্বেগজনক নয়, বরং ভয়ানক সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকেত বহন করে। গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রিয়াদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলেও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তাদের সম্পৃক্ততা একটি সুসংগঠিত মাদক সিন্ডিকেটে-যার শাখা-প্রশাখা ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহরের অলিগলি পর্যন্ত। ‘সমন্বয়ক’ নামটি শুনতে নিরীহ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহায়ক মনে হলেও বাস্তবে এরা পরিণত হয়েছে ভয়ানক মাদক ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের চালিকাশক্তিতে। রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলো-গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি কিংবা উত্তরা-যেখানে আগে মাদক ব্যবসা সীমিত ছিল, এখন সেসব এলাকায় সমন্বয়ক নামধারী চক্র পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তারা কৌশলে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে, পরে মাদক পরিবহন, হোম ডেলিভারি, চাঁদা আদায় এবং নতুন ভোক্তা তৈরির কাজে নিজেদের জড়ায়। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভেতরেও তারা এই মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে, এমনকি অনেকে তাদের মাদকচক্রের অংশ হিসেবেও জড়িত হয়ে পড়ছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কেউ বিরোধিতা করলে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটানোর ভয় দেখানো হয়, এমনকি সামাজিকভাবে হেনস্তা, অপদস্থ, কিংবা শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটছে। অর্থাৎ তারা একটি আধা-সাংগঠনিক, সহিংস এবং মাফিয়াধর্মী স্ট্রাকচার তৈরি করে নিয়েছে-যা কেবল অপরাধই নয়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি। মাদকের অবাধ প্রবাহ-ভারত ও মিয়ানমার থেকে জল, স্থল ও আকাশপথে এর অনুপ্রবেশ-কেবল সীমান্ত বা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ব্যর্থতার কথা নয় বলে প্রতীয়মান হয়। বরং এটি বোঝায়, মাদকচক্র এখন এতটাই শিকড় গেড়ে ফেলেছে যে, তারা নিজেদের প্রভাবশালী মহলের ছায়াতলে নিরাপদ আশ্রয়ও নিশ্চিত করতে পেরেছে। যদি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছদ্মবেশী চক্র এভাবে সক্রিয় থাকে, তাহলে তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যথার্থই বলেছেন, এই চক্রে প্রতিনিয়ত নতুন সদস্য যুক্ত হচ্ছে। পুরোনো কারবারিরা থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য রূপে, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেবল বাহক কিংবা ভোক্তা ধরতে পারলেও মূল হোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এখানেই রাষ্ট্রের শিথিলতা প্রকট হয়ে ওঠে। ডিএনসি কিংবা পুলিশের অভিযান যতই নিয়মিত হোক না কেন, যদি মূল অর্থের জোগানদাতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক কিংবা প্রভাবশালী সুবিধাভোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন, তাহলে এসব অভিযান হবে শুধুই প্রচারমূলক। অপরাধ নির্মূল নয়, বরং আরো সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত হয়ে সমাজের ভেতরে প্রবেশ করবে। অবিলম্বে প্রয়োজন, এই ‘সমন্বয়ক সিন্ডিকেট’-এর মূল কুশীলবদের চিহ্নিত করে শিকড় উপড়ে ফেলা, এবং তা করতে হবে রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো চাপের তোয়াক্কা না করে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button