সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রোত্তরণে জবাবদিহিতার প্রত্যাবর্তন

গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক বছর পর, বাংলাদেশ এখন একটি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি-যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অতীত আচরণ ও অপব্যবহারের জবাবদিহি সামনে চলে এসেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের গভীরতা ও বিস্তৃতি স্পষ্ট করে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সময়কালে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নির্যাতনের প্রেক্ষিতে গত ১১ মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি ১,১৬৮ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ৬১ জন। এমন পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, অতীতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার কতটা একতরফাভাবে করা হয়েছে, যা গণতন্ত্রের নীতিমালার পরিপন্থী। টিআইবির গবেষণা বলছে, শুধু পুলিশের বিরুদ্ধেই নয়, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশদাতা ও ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধেও এক হাজার ৬০২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩৮টি সরাসরি হত্যার অভিযোগসংবলিত। গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক সরকারঘনিষ্ঠ মন্ত্রী-এমপিসহ অন্তত ৮৭ জন। তদন্তে ৭০ শতাংশ মামলায় ‘সন্তোষজনক অগ্রগতি’র কথা বলা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারকাজে ধীরগতির ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার কার্যক্রমের পুনঃচালু হওয়া। শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি বার্তাই স্পষ্ট-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গণহত্যা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করলে, সেই অপকর্মের দায় এড়ানো সম্ভব নয়। তবে একইসঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে বলা প্রয়োজন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। প্রতিশোধ নয়, বরং সত্য উদঘাটন ও বিচার প্রতিষ্ঠাই হওয়া উচিত এই উদ্যোগের মূলমন্ত্র। অতীতের অন্যায়ের বিচার যদি আবার অন্য অন্যায়ের সূচনা হয়, তবে তা হবে একটি দুর্ভাগ্যজনক বৃত্তের পুনরাবৃত্তি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রশাসনিক বাহিনী কেবল সরকারের নয়, জনগণের সেবায় নিয়োজিত। অতীতে যারা সেই আস্থার অপব্যবহার করেছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হবে ভবিষ্যতের সুশাসনের ভিত্তি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button