সম্পাদকীয়

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে

সিসাদূষণের শিকার শিশুরা

ঢাকার দুই থেকে চার বছর বয়সী ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা আশঙ্কাজনক। আইসিডিডিআরবির এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সিসা এই শিশুদের শরীরে পাওয়া গেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই নীরব ঘাতক শুধু শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক বিকাশে বাধা দিচ্ছে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যেসব শিশু সিসানির্ভর শিল্প-কারখানার কাছাকাছি বসবাস করে, তাদের রক্তে সিসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। এর পাশাপাশি ঘরের ভেতরের ধোঁয়া, দূষিত ধূলিকণা, সিসাযুক্ত প্রসাধনসামগ্রী এবং রান্নার পাত্র থেকেও শিশুরা সিসার সংস্পর্শে আসছে। এটি কেবল ঢাকার সমস্যা নয়, ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, সিসাদূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ শিশু উচ্চমাত্রার সিসা নিয়ে জীবনধারণ করছে। এই ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে : সিসাদূষণ একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট, যা আমাদের মনোযোগের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় আইসিডিডিআরবির পূর্ববর্তী একটি সফল উদ্যোগ আমাদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। ২০১৯ সালে হলুদে ভেজাল হিসেবে ব্যবহৃত লেড ক্রোমেট চিহ্নিত করার পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়। এই সাফল্যের ঘটনা প্রমাণ করে যে যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো যায়, তবে সিসাদূষণের মতো গুরুতর সমস্যাও প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখন সময় এসেছে এই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করার। সিসা-এসিড ব্যাটারি কারখানা, সিসা গলানো বা পোড়ানো হয় এমন সব শিল্প-স্থাপনা এবং সিসাযুক্ত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। এসব প্রতিষ্ঠানকে হয় নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে হবে অথবা দূষণ নিয়ন্ত্রণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সিসাদূষণের কারণ ও এর মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। ড. তাহমিদ আহমেদ যথার্থই বলেছেন, সিসা বিষক্রিয়া নীরবে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেড়ে নিচ্ছে। শিশুদের সুস্থ ও বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে ওঠার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা। তাই শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় এখনই পদক্ষেপ না নিলে এর দায়ভার আমাদের সবাইকেই বহন করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button