হেপাটাইটিস-নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই প্রয়োজন

বিশ^ হেপাটাইটিস দিবসে আয়োজিত সেমিনারে প্রকাশিত তথ্য নতুন কোনো আতঙ্ক নয়, বরং পুরনো এক সতর্কবার্তা-যা আমরা বারবার উপেক্ষা করেছি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত, এবং প্রতি বছর মৃত্যু হচ্ছে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আক্রান্তদের ৯০ শতাংশই জানেন না যে তারা এই নীরব ঘাতকের বাহক। হেপাটাইটিস, বিশেষ করে বি ও সি টাইপ, শুধুই একটি ভাইরাল সংক্রমণ নয়-এটি ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস, লিভার ফেলিওর ও লিভার ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায়। তথ্য বলছে, বিশে^ লিভার ক্যান্সারের ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী এই দুই ভাইরাস। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এটি উপসর্গহীন, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না রোগ বাসা বেঁধেছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে যে তথ্যগুলো উঠে এসেছে, তা জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। কারণ এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল-চিকিৎসক, প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং জনগণের সমান অংশগ্রহণে। গ্রাম ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় সচেতনতার অভাব, নিরাপদ রক্তের সীমিত প্রাপ্যতা, জীবাণুমুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি-সব মিলিয়ে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ প্রতিরোধের উপায় খুব কঠিন নয়। হাত ধোয়া, বিশুদ্ধ খাবার ও পানি, নিরাপদ ইনজেকশন ও ব্লেড ব্যবহার, এবং সবচেয়ে জরুরি-হেপাটাইটিস এ ও বি টিকা গ্রহণ। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের স্ক্রিনিং ও শিশুদের জন্মের পরপরই টিকা দেওয়ার বিষয়ে জাতীয়ভাবে জোর দিতে হবে। গবেষণা বলছে, সময়মতো হেপাটাইটিস টিকা দিলে সংক্রমণের ঝুঁকি ৯০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০ শতাংশে। চিকিৎসা খাতে কর্পোরেট প্রভাব নিয়ে অধ্যাপক শাহিনুল আলমের মন্তব্যও বাস্তবধর্মী। চিকিৎসাসেবা হতে হবে রোগীকেন্দ্রিক, লাভকেন্দ্রিক নয়। গাইডলাইন অনুসরণ করে প্রয়োজনমতো কমদামী ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লেখা এবং রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষা নিরীক্ষা করা-এটাই আধুনিক চিকিৎসার ভিত্তি হওয়া উচিত। সবশেষে বলতেই হয়, হেপাটাইটিস শুধু একটি ভাইরাসজনিত রোগ নয়-এটি আমাদের স্বাস্থ্যনীতি, চিকিৎসা-নীতিবোধ, বৈষম্য এবং সচেতনতার মানদ-ও। এই রোগ প্রতিরোধে কোনো একক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, চিকিৎসা-সচেতন সমাজ, দায়িত্বশীল গণমাধ্যম এবং প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণ। নীরব ঘাতককে প্রতিরোধ করতে হলে এখনই সময় জেগে ওঠার।