সম্পাদকীয়

মব সহিংসতা: আইনের শাসনের প্রতি ভয়াবহ আঘাত

বাংলাদেশে মব সহিংসতা এখন এক অস্বস্তিকর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চার বছরের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে এ ধরনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯ জন, যা ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৪৬-এ। অর্থাৎ মাত্র চার বছরে মৃত্যুহার বেড়েছে পাঁচ গুণ। গত এক বছরে গড়ে প্রতি মাসে ১২ জনের বেশি মানুষ মবের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছরে নিহত হয়েছেন ১৭৭ জন। সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়-এগুলো আইনের শাসনের ভঙ্গুরতার স্পষ্ট প্রমাণ। এক সময় মব সহিংসতা মূলত চুরি, ডাকাতি বা ধর্ষণের মতো অপরাধে সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে দেখা যেত। কিন্তু এখন এর শিকার হচ্ছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। এতে বোঝা যায়, মবের হাতে বিচার করার প্রবণতা ক্রমে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, যা ভয়াবহ সংকেত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং গোয়েন্দা নজরদারির ঘাটতি-সব মিলিয়ে এই সহিংসতা ঠেকানো যাচ্ছে না। আইন ও বিচার বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও যদি এমন ঘটনা রোধ করা না যায়, তা প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব সহিংসতাকে আরও উসকে দিচ্ছে। মব সহিংসতা শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রের একচেটিয়া বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর সরাসরি আঘাত। পরিকল্পিত মব আক্রমণ হোক বা তাৎক্ষণিক গণপিটুনি-উভয়ের ফল একই: আইনের শাসনকে অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা জনতার উত্তেজনায় মানুষের জীবননাশ। এর শিকার হয়ে নিরপরাধ মানুষও প্রাণ হারাচ্ছেন। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে মানুষ আইনকে অগ্রাহ্য করেই নিজের হাতে বিচার তুলে নেবে-এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু এ পথ বিপজ্জনক এবং সমাজকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। এখন প্রয়োজন, দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে আইন প্রয়োগের সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ফেরাতে আইনি প্রতিকার প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে হবে। মব সহিংসতার প্রতিটি মৃত্যু শুধু একটি প্রাণহানি নয়, এটি আইনের প্রতি আস্থা হারানোর একেকটি দৃষ্টান্ত। এ প্রবণতা যত দিন চলবে, তত দিন আমাদের সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, বিভাজন ও সহিংসতার সংস্কৃতি আরও গভীর হবে। তাই এখনই রাষ্ট্রকে কঠোর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে আমরা ধীরে ধীরে আইনের শাসন থেকে সহিংসতার শাসনের দিকে এগিয়ে যাব।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button