নির্বাচনী রোডম্যাপ-বিশ^াসযোগ্যতা ও আস্থার বড় পরীক্ষা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে বিস্তৃত রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। নির্বাচনের প্রতিটি ধাপকে সময়সীমার মধ্যে এনে পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়নের ঘোষণা ভোটারদের কাছে আশার বার্তা বহন করে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আসনসীমা পুনঃনির্ধারণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক অনুমোদন, প্রবাসী ভোটের ব্যবস্থা, এমনকি কারাবন্দীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা-সবকিছুই রোডম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য এ ধরনের সুসংগঠিত পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। তবে কাগজে-কলমে পরিকল্পনা থাকলেই যে নির্বাচন বিশ^াসযোগ্য হবে, তা বলা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আস্থা সংকট। অতীতের নির্বাচনগুলো ঘিরে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক এখনো তাজা। সেই প্রেক্ষাপটে রোডম্যাপের সফলতা নির্ভর করবে এর যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা আসনসীমা পুনঃনির্ধারণের মতো কারিগরি কাজগুলোতে ন্যূনতম বিতর্ক থাকলেও, নির্বাচনকালীন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনই হবে মূল পরীক্ষা। ইসি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংলাপ যদি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত থাকে, তবে তা আস্থা ফেরাতে পারবে না। বরং দলগুলোর যৌক্তিক উদ্বেগ শোনা, সমাধানের চেষ্টা করা এবং অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে সংলাপের মূল সাফল্য। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অংশগ্রহণ। কোনো দল বা ভোটার যদি মনে করে ফল আগে থেকেই নির্ধারিত, তবে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়েও জনমনে কৌতূহল রয়েছে। আরপিও ও সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ যদি যথাসময়ে প্রণয়ন না হয়, তবে পুরো রোডম্যাপই ব্যাহত হতে পারে। একই সঙ্গে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ব্যালট মুদ্রণ, পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনতা, পোস্টাল ভোটিং বা প্রবাসী ভোটের মতো বিষয়গুলোতেও ইসিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। প্রযুক্তি ও আইসিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আইনশৃঙ্খলা। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা রোধ, ভীতি-সঞ্চার ঠেকানো এবং ভোটকেন্দ্রে সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হবে প্রশাসনের দায়িত্ব। এখানে সামান্য গাফিলতিও নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, ইসি কতটা স্বাধীনভাবে ও নিরপেক্ষভাবে এসব বাস্তবায়ন করতে পারবে। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশনকে শুধু ঘোষণায় নয়, কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কোনো চাপ বা প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করবে না। সবশেষে বলা যায়, ইসির ঘোষিত রোডম্যাপ একটি সুসংগঠিত কাঠামো দিয়েছে। তবে কাঠামো নয়, বিশ^াসযোগ্যতা তৈরি করাই হবে কমিশনের মূল চ্যালেঞ্জ। জনগণ একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সেই প্রত্যাশা পূরণে ইসিকে সততা, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে এগোতে হবে। তবেই রোডম্যাপ বাস্তবে সফল হবে।
