সম্পাদকীয়

গুম প্রতিরোধ আইন-অতীতের দায় মেটাতে ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশে গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন বহুদিন ধরে আলোচিত। দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে যে উদ্বেগ বিরাজ করছে, তা মোকাবিলা এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই সরকার ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে। খসড়াটিতে গোপন আটককেন্দ্র বা ‘আয়নাঘর’ স্থাপন ও ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা এবং গুমের মতো অপরাধের জন্য মৃত্যুদ-সহ কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জরুরি অবস্থা কিংবা যেকোনো অজুহাতে গুম করা যাবে না। সরকারি বা বেসরকারি, সামরিক বা বেসামরিক-যে-ই এ অপরাধে জড়িত থাকুক না কেন, তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনকি কারও মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পরও যদি প্রমাণিত হয় যে তিনি গুমের শিকার, তবে সংশ্লিষ্টদের দায় বহন করতে হবে। এ ছাড়া সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্ট বা গোপন করার চেষ্টাও আলাদা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অধ্যাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো, গুমের তদন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, বরং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন করবে। এতে তদন্তের নিরপেক্ষতা রক্ষার চেষ্টা স্পষ্ট। একই সঙ্গে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে অভিযোগ গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এতে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় ভুগবে না, এমন প্রত্যাশা করা যায়। খসড়ায় ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের জন্য পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ও আইনগত সহায়তার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে মানবিক উদ্যোগ। গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পত্তি ব্যবহার বা হস্তান্তর নিয়েও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে তাঁদের পরিবার অন্তত দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকতে পারে। এই উদ্যোগের পেছনে আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিও বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ (জোরপূর্বক গুম প্রতিরোধ বিষয়ক)-এ অংশ নিয়েছে। সংবিধানে সংরক্ষিত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার কার্যকর করতে এই আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে উঠেছিল। ফলে অধ্যাদেশটি শুধু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়; বাস্তবে প্রয়োগই আসল চ্যালেঞ্জ। অতীতের বহু ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন শক্তির আশ্রয়ে দায়ীরা রেহাই পেয়েছে। এবার যদি সেই ধারা বজায় থাকে, তবে আইন কতই না শক্তিশালী হোক, আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে না। তদন্তে মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করলেই কেবল এই আইন কার্যকর হবে। সুতরাং, গুম প্রতিরোধ আইন কেবল একটি আইনি উদ্যোগ নয়-এটি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায় মেটানোর প্রচেষ্টা। এখন সময় এসেছে প্রমাণ করার যে বাংলাদেশ আর গুমের মতো অমানবিক অপরাধ বরদাস্ত করবে না।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button