সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের সুরক্ষা: বিলম্ব আর সহনীয় নয়

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার আট বছর পরও রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের জীবনে সহিংসতার ছায়া ঘনীভূত। একশনএইড বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে-সহিংসতার ধরণ বদলালেও তার তীব্রতা কমেনি। যৌন হয়রানি, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে থেকে শুরু করে সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম ও মাদক বিস্তার-সবকিছু মিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারীদের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত ভঙ্গুর হয়ে উঠছে। গবেষণার তথ্য বলছে, মাত্র সাত শতাংশ নারী স্বাধীনভাবে আইনি সহায়তা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। বাকিরা মূলত ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই ব্যবস্থার ভেতরেই ভীতি, পাল্টা প্রতিশোধ এবং স্বচ্ছতার অভাব বিরাজ করছে। ফলে অভিযোগ করার সাহসী পদক্ষেপও প্রায়শই অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে স্থানীয় সমাজেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বেড়েছে। অর্থাৎ সংকটটি শুধু ক্যাম্পসীমিত নয়; এটি বৃহত্তর সামাজিক ও মানবিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ফেলছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক কাঠামোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-নারী ও কিশোরীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। অধিকাংশ নারী মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশা করলেও, তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছে। দীর্ঘমেয়াদে এই দ্বৈত মনোভাবও অনিশ্চয়তা ও হতাশা বাড়াচ্ছে। গবেষণায় আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে-প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী মনে করেন, পুরুষ ও ছেলেদের জন্য কাউন্সেলিং অপরিহার্য। এটি নিছক একটি সুপারিশ নয়, বরং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত। নারী সুরক্ষা কেবল নারীদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরির মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে না; এর জন্য পুরুষদের মানসিকতা ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাও জরুরি। বাংলাদেশ শুরু থেকেই মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এত বছর পরও যদি তাদের মৌলিক সুরক্ষা, বিশেষত নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়, তবে তা কেবল শরণার্থীদের জন্য নয়-আমাদের জন্যও এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখনই প্রয়োজন অধিকারভিত্তিক, জেন্ডার-সংবেদনশীল ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। শুধু মানবিক সাহায্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষা, জীবিকা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকটকে একটি বৈশি^ক মানবিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের কণ্ঠস্বর আজ স্পষ্ট-তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সময় নষ্ট করার আর অবকাশ নেই। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সমাজের সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকটের সমাধান অসম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button