সম্পাদকীয়

প্রতিরোধে চাই সুসংহত কৌশল

নৌপথে মানবপাচার

উন্নত জীবনের আশায় মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে, তখন সেই স্বপ্নকে পুঁজি করে গড়ে ওঠে ভয়ংকর দালালচক্র। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার উপকূল হয়ে নৌপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এই চক্রের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাচারকারীরা কখনো প্রতারণা, কখনো জোরপূর্বক অপহরণ করে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে ট্রলারে তুলে দিচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে অথবা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে ট্রলারে তুলে জিম্মি করা হচ্ছে। মানবপাচারের এই ব্যবসা অত্যন্ত সুসংগঠিত ও বহুস্তরীয়। তথ্যদাতা থেকে শুরু করে ট্রলার পার্টি- কমপক্ষে আটটি ধাপে হাতবদল হয়ে ভুক্তভোগীরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছায়। প্রতিটি ধাপে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে চলে অমানবিক নির্যাতন। পাচারকারীরা শুধু অর্থলোভী নয়, তারা মানুষকে পণ্য হিসেবে কেনাবেচার মতো জঘন্য কাজেও লিপ্ত। এই নৌপথে সামুদ্রিক দুর্ঘটনা, অনাহার কিংবা পাচারকারীদের মারধরে অসংখ্য প্রাণহানির নজির ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ক্যাম্পে অনিশ্চিত জীবন, উন্নত জীবনের মোহ এবং পরিবার পুনর্মিলনের আকাক্সক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছে দালালচক্র। ফলে একদিকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও জড়িয়ে পড়ছে এই ভয়ংকর চক্রে। সম্প্রতি বাহারছড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে শত শত ভুক্তভোগীকে উদ্ধার এবং দালালদের গ্রেপ্তার করা হলেও চক্রটি বারবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থা প্রমাণ করে, শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন সুসংহত দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত এই চক্রটি অত্যন্ত শক্তিশালী। লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণের বোঝা অনেক পরিবারকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। মানবপাচার দমন এখন একটি জাতীয় চ্যালেঞ্জ। সীমান্ত পাহারা জোরদার, দালালদের আর্থিক লেনদেন চিহ্নিত করে বন্ধ করা, পাচার প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা—সবই জরুরি। একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পরিবার-পরিজনের ভবিষ্যতের স্বপ্নে কেউ যেন দালালচক্রের প্রলোভনে না পড়ে, সে বিষয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। মানবপাচারকারীরা যতই শক্তিশালী ভাবুক না কেন, রাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপে তাদের দমন করা সম্ভব। এখনই যদি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে আসন্ন শীত মৌসুমে নৌপথে মানবপাচারের চিত্র আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এই অমানবিক ব্যবসা রুখতে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সমাজের সব স্তরের সম্মিলিত পদক্ষেপের বিকল্প নেই।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button