সম্পাদকীয়

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র: নি¤œমানের কয়লায় বিপর্যয়

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে নতুন যুগের সূচনা ঘটানোর প্রত্যাশায় নির্মিত মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আজ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও মানহীন কয়লার কারণে বারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও কেন্দ্রটির একটি ইউনিট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরেকটি অর্ধেক উৎপাদনেও হিমশিম খাচ্ছে। সমস্যার মূল কারণ একটাই-নি¤œমানের কয়লা সরবরাহ। শুরু থেকেই জাপানি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে উচ্চমানের কয়লার ওপর নির্ভর করে পরিচালনার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কয়লার সঙ্গে পাথরের খ-, মাটি ও অন্যান্য বর্জ্য মিশিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে, যা শুধু উৎপাদন ব্যাহত করছে না, বরং যন্ত্রপাতিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এমনকি শ্রমিকদেরও গুণমানহীন কয়লা পরিষ্কারে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতিবাদ করলে তাঁদের ভয়ভীতি ও শাসন-হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সংকট কোনো এককালীন দুর্ঘটনা নয়; এটি প্রায় প্রতিটি চালানে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। গত মার্চে ‘এমভি ওরিয়েন্ট অর্কিড’ জাহাজে আসা কয়লার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ কাদা ও পাথর মেশানো থাকায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ‘লিলাফুজি’ জাহাজের চালানেও একই চিত্র। এর ফলে কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি বারবার বিকল হয়ে পড়ছে, উৎপাদন কমছে, এমনকি পুরো ইউনিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, কেন্দ্রের অভ্যন্তরে এসব অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গণমাধ্যমে তথ্য ফাঁসের সন্দেহে শ্রমিকদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে, এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও কোনো তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে না। এতে বোঝা যায়, অনিয়ম রক্ষায় একটি অস্বচ্ছ বলয় কাজ করছে। বাস্তবতা হলো, নি¤œমানের কয়লা সরবরাহের কারণ স্পষ্ট-বেশি মুনাফার লোভ। ইন্দোনেশিয়ার কয়লা খনির মানে পার্থক্য থাকলেও চুক্তিভিত্তিক সরবরাহে সেই মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু তা না হওয়ায় জাতীয় সম্পদে পরিণত হওয়ার কথা থাকা এই প্রকল্প এখন লোকসানের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কর্তৃপক্ষকে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি। কয়লার গুণমান যাচাই ও গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদ- কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এছাড়াও নি¤œমানের কয়লা সরবরাহে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরাও সঠিক তথ্য পান। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও শিল্পায়নের ভবিষ্যৎ অনেকটাই এই প্রকল্পের সফলতার সঙ্গে যুক্ত। তাই সময় থাকতে যদি মানহীন কয়লার কেলেঙ্কারি বন্ধ না করা যায়, তবে মাতারবাড়ী প্রকল্প জাতীয় গর্ব নয়, বরং ব্যর্থতার প্রতীকে পরিণত হবে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button