ব্যাংক খাতে অনিয়মের ছড়াছড়ি: সুশাসন ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক টিকবে না

বাংলাদেশের আর্থিক খাত নানা অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে ক্রমেই আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। একদিকে এমএফএস বা মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস খাতে হাজার কোটি টাকার অনিয়মিত লেনদেন, অন্যদিকে ই-কমার্স প্রতারণা কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ চুরির ঘটনা-সব মিলিয়ে খাতটির সুনাম তলানিতে এসে ঠেকেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, দুদক অভিযানে এক এমএফএস প্রতিষ্ঠানের লেনদেনে ৬০০ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রায় ২৩০০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। একইভাবে ই-ভ্যালি নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক প্রতারণার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে নাড়া দেওয়া ঘটনারও এখনো কোনো সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হয়নি। এই বাস্তবতায় যখন প্রচলিত ব্যাংকগুলোই খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে দেউলিয়ার পথে যাচ্ছে, তখন নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার তোড়জোড় যৌক্তিক প্রশ্ন তোলে। বর্তমানে দেশে কার্যকর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১-যা অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক বেশি। খেলাপি ঋণ এখন চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অনেক ব্যাংক গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। অথচ রাজনৈতিক প্রভাবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে। অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ঋণ বিতরণ বা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের মতো উদাহরণ দেখিয়েছে, শৃঙ্খলা ও সুশাসনহীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেবল অর্থনীতি নয়, জনগণের আমানতের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে। অর্থনীতিবিদরা তাই মনে করেন-ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ানো বা নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন নয়, বরং এখন সবচেয়ে বেশি দরকার আর্থিক খাতে আস্থা পুনঃস্থাপন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার অবশ্যই সময়ের দাবি, তবে প্রযুক্তি নির্ভর সেবাও ভেঙে পড়বে যদি মূল কাঠামোতে সুশাসন না থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত প্রথমে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা, খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া এবং এমএফএস খাতসহ আর্থিক সেবায় কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অন্যথায় ডিজিটাল ব্যাংকের নামে নতুন করে লাইসেন্স দেওয়া কেবল খাতটির বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা আরও বাড়াবে। আস্থা ফিরিয়ে আনা এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কারণ জনগণের সঞ্চয় ও অর্থনীতি দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়ছে যখন আর্থিক খাত জালিয়াতি ও অনিয়মের শিকার হয়। ডিজিটাল ব্যাংক নয়, এখন সময় সুশাসনের।
