সম্পাদকীয়

অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ও খামার সংকট: প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক সচেতনতা

রংপুর ও গাইবান্ধা অঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব আবারও স্থানীয় খামারিদের জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পীরগাছা, সুন্দরগঞ্জ, কাউনিয়া ও মিঠাপুকুরে সাম্প্রতিক আক্রান্তের ঘটনা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, পীরগাছার বাবু মিয়া কিংবা হাবিবুর রহমানের মতো শত শত ক্ষুদ্র খামারি অ্যানথ্রাক্সের আতঙ্কে তাদের পশু অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। যেসব পশু পরিবারগুলোর একমাত্র পুঁজির উৎস ছিল, তা এখন ক্ষতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে যেমন পশুপালন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় বাজারে মাংসের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে-কারণ, অনেকেই ঝুঁকি না বুঝে আক্রান্ত এলাকার পশু কম দামে কিনে বিক্রি করছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য বলছে, রংপুর বিভাগে মোট গরু ও ছাগলের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকা, পুষ্টি ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এই খাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই অ্যানথ্রাক্স কেবল একটি রোগ নয়; এটি এখন একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। অ্যানথ্রাক্স রোগ মূলত ব্যাকটেরিয়াজনিত, এবং তা সময়মতো ভ্যাকসিন ও সঠিক ব্যবস্থাপনা নিলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু বাস্তব সমস্যা হচ্ছে, তথ্যের অভাব ও আতঙ্ক। স্থানীয় অনেকেই মনে করছেন, অ্যানথ্রাক্স “ছোঁয়াছে”এবং আক্রান্ত পশু মানেই মৃত্যুর আশঙ্কা-যা আসলে ভুল ধারণা। ফলে আতঙ্কে খামারিরা পশু বিক্রি করছেন, আবার ক্রেতারা কম দামে তা কিনে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন। ভালো দিক হলো, প্রাণিসম্পদ বিভাগ ইতিমধ্যে মাঠে একাধিক টিম পাঠিয়েছে, ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে, এবং মাইকিং ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতনতা ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা এখনো সীমিত পরিসরে। অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, প্রাণিসম্পদ অফিস ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রয়োজন, মাঠপর্যায়ে দ্রুত ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচি জোরদার করা, খামারিদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং আক্রান্ত পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা অনুসরণ। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল প্রচারও জরুরি-যাতে গুজবের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার পায়। অ্যানথ্রাক্স কোনো অজেয় রোগ নয়। এটি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে মৌসুমি সংক্রমণ হিসেবে দেখা দেয়, এবং প্রতিবারই আতঙ্কের চেয়ে বাস্তব সংক্রমণ কম থাকে। কিন্তু সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতিই একে বড় সংকটে রূপ দেয়। রংপুর-গাইবান্ধার বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে-রোগের ভয় নয়, সঠিক তথ্য ও সময়োপযোগী পদক্ষেপই হতে পারে সর্বোত্তম প্রতিরোধ। আতঙ্ক নয়, আস্থা ফিরিয়ে আনার সময় এখনই।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button