সম্পাদকীয়

অর্থনীতিতে ধীরগতি ও পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। বিশ^ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশে-যা এক দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। মূল্যস্ফীতির লাগামহীনতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ঋণ সংকট ও ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অনীহা অর্থনীতির গতি শ্লথ করেছে। অর্থনীতির এই মন্দা শুধু প্রবৃদ্ধির সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ পরিবেশকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে, বিশেষত নারীদের অংশগ্রহণ হ্রাস অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। শিল্প ও নির্মাণ খাতের স্থবিরতা কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করেছে, আর সেবা খাতে মন্দা নগরজীবনের গতিশীলতাকেও থামিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। খেলাপি ঋণ ২৪ শতাংশ ছাড়ানো এবং মূলধনঝুঁকি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া আর্থিক খাতের ওপর আস্থার সংকট তৈরি করছে। সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’সহ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও এর ফলাফল এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ৮.৮ শতাংশ বৃদ্ধি এবং প্রবাস আয়ে ২৬ শতাংশের উন্নতি অর্থনীতিকে কিছুটা স্থিতিশীলতা দিয়েছে। দীর্ঘ আট বছর পর চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে আসা অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার ইঙ্গিত দেয়। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রাজস্ব খাতে দুর্বলতা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে আরও গভীর করেছে। কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৭.৪ শতাংশ থেকে কমে ৬.৮ শতাংশে নেমে এসেছে, অথচ ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়েছে। এতে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৪.৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা স্পষ্ট করে। সরকারের নেওয়া কর প্রশাসন সংস্কার ও ডিজিটাল রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে, তবে বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে। বিশ^ব্যাংক আশা করছে, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ৪.৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও জ্বালানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতা এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় প্রধান বাধা হয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীতে বহু সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে। এবারও সেই সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে দরকার নীতিগত স্থিতিশীলতা, কার্যকর সংস্কার এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। প্রবৃদ্ধির সংখ্যা নয়, বরং এর গুণগত মান ও টেকসই কর্মসংস্থানই হতে হবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button