মহাসড়ক অব্যবস্থাপনা: সংস্কারের গতি ফিরুক জনস্বার্থে

দেশের উন্নয়নচিত্রে মহাসড়ক হলো প্রাণরেখা। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ১,৪৭৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন প্রায় ২,৯০৭ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ। অথচ গত অর্থবছরে বরাদ্দের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে-এ যেন উন্নয়ন কাঠামোর এক নিদারুণ চিত্র। প্রকৌশলীদের বক্তব্যে স্পষ্ট, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, অতিরিক্ত ভারবাহী যান চলাচল, দুর্বল দরপত্র প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক জটিলতাই আজকের এই দুরবস্থার মূল কারণ। বিশেষত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশটি এখন ভোগান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাস্তার গর্ত, ঢেউখেলানো পিচ, ও পাশ ধসে যাওয়া অংশ-সব মিলিয়ে যানজট, দুর্ঘটনা ও অর্থনৈতিক ক্ষতির এক স্থায়ী চিত্র সৃষ্টি করেছে। রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে ভাঙা রাস্তার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অথচ এগুলোই কৃষি, শিল্প ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট। অর্থাৎ মহাসড়কের এই অবস্থা কেবল যানবাহন চলাচলের সমস্যা নয়-এটি জাতির উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলেরও বড় বাধা। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক সংস্কার ও ঠিকাদার যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হলেও, তা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটিয়েছে। ঠিকাদারি অদক্ষতা, কালোতালিকাভুক্তি ও নতুন ঠিকাদার অন্তর্ভুক্তির জটিলতায় বহু দরপত্র ঝুলে আছে। ফলে মহাসড়কে রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্যই সওজের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় কাক্সিক্ষত জবাবদিহি ফিরিয়ে আনা জরুরি। যেভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনা অব্যবস্থাপনায় রূপ নিচ্ছে, তা অবকাঠামো উন্নয়নের অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রতি বছর বরাদ্দ কমে আসছে, অথচ প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও দক্ষ প্রকল্প পরিচালনা ছাড়া টেকসই সড়কব্যবস্থা গড়া সম্ভব নয়। সরকারি পর্যায়ে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন “পারফরম্যান্স-ভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ কাঠামো”-যেখানে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের কাজের মান নিয়মিত মূল্যায়িত হবে। একইসঙ্গে অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সড়কনির্ভর শিল্প খাতের জন্য বিকল্প পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি। জনগণের প্রত্যাশা, মহাসড়ক কেবল উন্নয়ন পরিসংখ্যানে নয়-বাস্তবে চলাচলের উপযোগী হবে। দেশের অর্থনীতি ও নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থেই এখন সময় এসেছে সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কারে কঠোর পদক্ষেপের। নইলে অবহেলা, বিলম্ব ও অপচয়ের এই চক্র থেকেই যাবে-আর ভোগান্তির ভার বইবে সাধারণ মানুষ।