আত্মহত্যার বেড়ে চলা প্রবণতা: নীরব সমাজের আত্মসমালোচনার সময়

নারায়ণগঞ্জে আত্মহত্যার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো যেন এক ভয়াবহ সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। দৈনিক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, মাত্র একদিনে, গত ১১ অক্টোবর, সোনারগাঁওয়ে মা ও সন্তানের আত্মহনন, একই এলাকায় স্বামী-স্ত্রীসহ চারজনের মৃত্যু-সমাজকে আবারও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। পুলিশের তথ্যমতে, শুধু নারায়ণগঞ্জেই ২০২১ সালে ২৩৮ জন থেকে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৪ জনে। ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্তও আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনক। এ যেন ক্রমবর্ধমান হতাশার প্রতিচ্ছবি এক ব্যস্ত শহরের আড়ালে। সমীক্ষা বলছে, প্রেমে ব্যর্থতা, পরকীয়া, মাদক, যৌতুক, বেকারত্ব, আর্থিক অভাব, পারিবারিক কলহ এবং সামাজিক লজ্জার ভয়-এসবই মানুষকে চরম সিদ্ধান্তে ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, গত পাঁচ বছরে ২৭৬ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। কৈশোর ও তারুণ্যের এই মৃত্যু সমাজে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। গেম খেলতে না দেওয়া, পরীক্ষায় ব্যর্থতা কিংবা মোবাইল না পেয়ে জীবন শেষ করে দেওয়া-এমন বাস্তবতা নিঃসন্দেহে এক মানবিক বিপর্যয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আত্মহত্যা কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়; এটি দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, হতাশা ও অসহায়তার ফল। অথচ এই সংকট মোকাবিলায় সমাজে প্রায় কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি সংস্থা-কেউই কার্যকর কাউন্সেলিং বা সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। সরকারিভাবেও নেই সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। ফলে মানুষ একা হয়ে পড়ছে-পরিবারে, সমাজে, এমনকি নিজের মধ্যেও। আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি ও সমাজকর্মীরা একমত-সমস্যার মূল শেকড় সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোয়। পরিবারে যোগাযোগের অভাব, পারস্পরিক শ্রদ্ধার সংকট, আর অপ্রতুল মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা-এসব মিলে তৈরি হচ্ছে আত্মঘাতী মনোভাবের উর্বর ক্ষেত্র। তাই আত্মহত্যা ঠেকাতে আইনি পদক্ষেপের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবিক উদ্যোগ ও মানসিক সহায়তার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও এখানে বড় ভূমিকা আছে। দায়িত্বশীল প্রচার, গণসচেতনতা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, এবং অনলাইন অপব্যবহার রোধে কার্যকর আইন প্রয়োগ-এসবই জরুরি। একই সঙ্গে পরিবারকে হতে হবে যতœশীল, বিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে পরামর্শকেন্দ্র, আর সমাজকে হতে হবে সহানুভূতিশীল। একটি প্রাণ হারানো মানে শুধু একজনের মৃত্যু নয়-একটি পরিবার, একাধিক সম্পর্ক, একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ভাঙন। তাই আত্মহত্যা নয়, জীবনের পক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি।