উপকূলের মানুষের আর্তনাদ-স্থায়ী সমাধান কোথায়?

কপোতাক্ষ নদের পাড়ে প্রজা বর্মণের কথা-“যত সময় খাটা, তত সময় খাওয়া”-আজকের উপকূলীয় জীবনের নির্ভুল প্রতিচ্ছবি। খুলনা-সাতক্ষীরার উপকূল এখন এক দীর্ঘ সংগ্রামের নাম। নদীভাঙন, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়, বাঁধভাঙা-সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ প্রতিদিন বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের পর নতুন করে জীবন গড়ার চেষ্টাই যেন তাদের একমাত্র নিয়মিত কাজ। একসময় কৃষক ছিল যাদের পরিচয়, আজ তারা নদীর চর বা বাঁধের পাশে অস্থায়ী ঘরে বাস করে দিনমজুর বা মাছচাষে নিয়োজিত। প্রজা বর্মণ বা ঠাকুরপদ বিশ^াসদের গল্প আসলে লাখো মানুষের গল্প। ১৯৮৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তিনবার বাড়ি হারানো মানুষের সংখ্যা অগণিত। ঘরবাড়ি, জমি, জীবিকা-সবকিছু গিলে নিচ্ছে নদী। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে এই বাস্তচ্যুতি যেন এক অনন্ত চক্রে পরিণত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সিডর, আইলা, আম্ফানসহ প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। শুধু আইলা ও আম্ফানে বাস্তচ্যুত হয় প্রায় ৫০ হাজার পরিবার, হারায় ২৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। সেই জমিগুলোর অধিকাংশই আজ লবণাক্ততার কারণে অনুর্বর। অর্থাৎ, ক্ষতির পরিমাণ শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটেও পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দাকোপের বটবুনিয়ায় বাঁধ ভেঙে ফসল ও মাছের ঘের ডুবে যাওয়ার ঘটনা আবারও দেখিয়ে দিয়েছে-আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা এখনো স্থায়ী সমাধান দিতে ব্যর্থ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পগুলোতে টেকসই পরিকল্পনার ঘাটতি, মানহীন কাজ ও তদারকির অভাব প্রকট। ফলাফল, জোয়ারের পানিতে প্রতিবারই ভেসে যায় বছরের পর বছর পরিশ্রমের ফল। অন্যদিকে, সুন্দরবনঘেঁষা মানুষের জীবিকা এখনো নির্ভর করে বন ও নদীর ওপর-মধু, মাছ, কাঁকড়া বা গোলপাতা আহরণে। কিন্তু সেই জীবনেও নতুন দুঃখের নাম ‘দাদন’। দাদনপ্রথার ফাঁদে পড়ে তারা আরও অসহায়, ঋণের বোঝায় পিষ্ট। একদিকে প্রকৃতির রোষ, অন্যদিকে মানুষের শোষণ-এই দুই চাপেই উপকূলের মানুষ আজ বিপর্যস্ত। এখন সময় এসেছে উপকূলকে আর শুধু দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে নয়, জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশ নিরাপত্তার কেন্দ্র হিসেবে ভাবার। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি নদীখাত পুনঃখনন, টেকসই বেড়িবাঁধ, ও দাদনমুক্ত বিকল্প জীবিকার সুযোগ। উপকূলের মানুষ শুধু সহায়তার নয়, সম্মানজনক জীবনের দাবিদার। প্রজা বর্মণদের আর যেন বলতে না হয়, “যত সময় খাটা, তত সময় খাওয়া।” তাদের জীবনের নিরাপত্তাই হোক উন্নয়নের প্রকৃত সূচনা।