সম্পাদকীয়

সুন্দরবনে ফের দস্যুরা-অবহেলার মূল্য দিতে পারে গোটা উপকূল

একসময় দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল সুন্দরবনকে। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে এই বনাঞ্চল ফিরে পেয়েছিল স্বস্তি, জেলেদের মুখে ফিরেছিল হাসি। কিন্তু মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে সেই শান্ত সুন্দরবন আবার রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, অন্তত ২০টি দস্যু বাহিনী এখন সক্রিয়, যাদের মধ্যে অনেকেই আগের আত্মসমর্পণকারী দলের সদস্য। তারা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে জেলে, বনজীবী ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করছে। গত এক বছরে তিন শতাধিক জেলে অপহৃত ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন-এ তথ্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক ভয়াবহ প্রতিফলন। অনেক ব্যবসায়ী ভাষ্য অনুযায়, এখন বনাঞ্চলে প্রবেশ করতেই দিতে হয় ‘টোকেন’ বা চাঁদা। নৌকাপ্রতি দিতে হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, আর অপহৃত হলে মুক্তিপণ গুনতে হয় লাখ টাকার ঘরে। এতে জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনে যেতে ভয় পাচ্ছেন, ফলে উপকূলীয় অর্থনীতি এবং মৎস্য খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দস্যুদের উত্থান শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। ২০১৮ সালের পুনর্বাসন কার্যক্রমে আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের জীবিকার নিশ্চয়তা এবং সামাজিক পুনঃএকীকরণ টেকসইভাবে হয়নি। ফলে তারা আবার পুরোনো পেশায় ফিরে গেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল গোয়েন্দা তৎপরতা এবং স্থানীয় ‘গডফাদারদের’ মদদ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে-কোস্ট গার্ডের তথ্যমতে, এক বছরে ২৭টি সফল অভিযানে ৪৪ জন দস্যু আটক হয়েছে। তবু প্রশ্ন রয়ে যায়-কেন তাদের দমনসফলতা মাঠপর্যায়ে স্থায়ী শান্তি আনতে পারছে না? কারণ, দস্যু দমনে অভিযান প্রয়োজন হলেও, এর চেয়েও জরুরি হলো দস্যু তৈরির পরিবেশ নির্মূল করা। বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও সামাজিক পুনর্বাসন ছাড়া এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন, দস্যুদের টেকসই পুনর্বাসন এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত না হলে সুন্দরবন আবার জলদস্যুেদর রাজ্যে পরিণত হবে। একই সঙ্গে বন দস্যুতার প্রভাবে বাঘ, হরিণসহ বনের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে। দস্যুরা শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতিকেও হত্যা করছে। সরকার ও প্রশাসনের উচিত, এখনই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা-শুধু অভিযান নয়, পুনর্বাসন, তদারকি ও স্থানীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়; এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণরক্ষাকারী ঢাল। সেখানে যদি আবার দস্যুেদর রাজত্ব কায়েম হয়, তবে তার মূল্য দিতে হবে পুরো উপকূল, এমনকি পুরো জাতিকেও।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button